স্বাস্থ্যখাতে চলছে দুর্নীতি : ১৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা দুদকে

স্বাস্থ্যখাতে

Kjkhan :   দেশের স্বাস্থ্যখাত এখন অব্যবস্থাপনার আতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। করোনার মতো মহাদুর্যোগে বের হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে চলা সিন্ডিকেটের গোমর। শৃঙ্খলা ফেরাতে শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। তালিকায় অছেন ডজনখানের কর্মকর্তা। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিষয়ে আনেক আগেই অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের এ তালিকায় রয়েছে ১৫০ জনের নাম। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের ১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যে নাম দুদকের কাছে রয়েছে, তাদের মধ্যে ৩০ জন চিকিৎসক। এছাড়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ রয়েছেন ৭-৮ জন। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম এখনই প্রকাশ করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে দুদক।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক চিঠি দেয় দুদক।

সরিয়ে দেয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ডজনখানেক কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে বদলি করা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বেশ কয়েকজনকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটনার তদন্ত না করে শুধু বদলি লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নেই। এদিকে দুদক বলছে, কেন এই কর্মকর্তাদের বদলি করা হচ্ছে, সে বিষয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য চেয়েছে তারা।

এর আগে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে, তা প্রতিহতের জন্য মন্ত্রণালয়ে ২৫ দফা সুপারিশ করে দুদক। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্রয়, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসা দেয়া, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইকুপমেন্ট ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়।

এসব উৎস বন্ধে দুদকের করা সুপারিশের ছিল- তথ্য বহুল সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন, মালামাল রিসিভ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সংস্থার সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ,

ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন ও অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্থায়ী চিকিৎসক বা কর্মচারী ও কার্যনির্বাহী কমিটি ইত্যাদি রয়েছে। কিন্তু না এসব বিষয় নিশ্চিত হওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির নীতিমালা প্রণয়ন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা; ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করা এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক করা, চিকিৎসকদের (সরকারি/ বেসরকারি) পদোন্নতির জন্য সরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে পিএসসি এবং বেসরকারিদের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য) এবং পিএসসির প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে সুপারিশ দেয়া যেতে পারে।

চলতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদফতরে এক পরিচালকসহ ৪ কমকর্তাকে সরানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে রদবদল হয়েছে সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে। অধিদফতরের বদলিকৃত পরিচালকের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় ও পরিকল্পনায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জনগণের স্বাস্থ্যসেবার অর্থ আত্মসাৎ করেছে তাদের ছাড় দেয়া হবে না। এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আশা করছি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।

চেয়ারম্যান আরো জানান, মাস্ক-পিপিই এগুলো আমরা যখন রিপোর্ট দিয়েছি, রিপোর্টের পরের ঘটনা এগুলো। সো দেয়ার ইজ নো লিঙ্ক বিটুইন আওয়ার রিকোম্যান্ডশন। বদলি কোনো রিফর্ম ইন্ডিকেট করে না। আপনি একটা অন্যায় করলেন বা আপনাকে বদলি করা হলো, ইট ইজ নট দ্যা সল্যুশান। বদলির বিষয়ে আমরা তথ্য চেয়েছি। কারণ যাদের বদলি করা হয়েছে, তারা সত্য বলাতে বদলি হয়ে গেছেন, এমন অভিযোগ আছে।

দুদকের একজন পরিচালক জানান, তিনজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে তিনটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। তারা দুদকের কাছে চিঠি দিয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামাান বলেন, কোভিড-এর কারণে স্বাস্থ্যখাতে দুই ধরনের দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে? প্রথমত, স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি এবং দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে দুর্নীতি। ক্রয় ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় এই খাতে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। আমরা এই করোনা সংকটের মধ্যেও সেই দুর্নীতি দেখেছি। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক আরো জানান, এননাইন্টি ফাইভ মাস্কের মতো ঘটনাগুলো সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা উচিত। এটা যদি শুধুই রদবদল হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বেড়েছে ভালো কথা। কিন্তু এটা পরিকল্পনাহীন। থোক বরাদ্দ কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় নয়। এর ফলে যা হয়, এই বরাদ্দের ৮০ ভাগ চলে যায় ব্যক্তিগত তহবিলে? দুর্নীতি খেয়ে ফেলে। তাহলে আর বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী?

দুদক বলছে, সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যক্তিরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি করছে। তারা সিন্ডিকেট করে জনসাধারণের জন্য করা সরকারের বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই নিজেদের দখলে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আইসোলেশনে থাকার কথা জানান অভিযুক্ত পরিচালক ডা. ইকবাল কবীর। বদলি হয়ে যাওয়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জানালেন, তিনি এখন নতুন কর্মক্ষেত্র কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়া ভাবছেন না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাবিুবর রহমান খান জানান, সিন্ডিকেট সাধারণত থাকে নরমাল কেনাকাটা বেজড, প্রকিউরম্যান্ট বেজডে সিন্ডিকেট থাকতে পারে না। আমি যেহেতু প্রকিউরম্যান্ট দেখতাম না, কাজেই আমার ঠিক ধারণা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র বদলির মাধ্যমে যেন দুর্নীতির ঘটনাগুলো চাপা পড়ে না যায়। দুদকের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে থাকার সুবাদে দুর্নীতির সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিকও হয়েছেন। দুদকে তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে সরকারি চিকিৎসক আছেন ৩০ হাজার। আর সবমিলিয়ে নিবন্ধিত চিকিৎসক আছেন এক লাখের মতো। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীর হিসেব ধরলে সব মিলিয়ে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি নয়। বাংলাদেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট হাসপাতালের সংখ্যা সাত হাজার ৩১২টি? এর মধ্যে সরকারি হাসপাতাল দুই হাজার ২৫৮টি, যার মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকও ধরা হয়। পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ২৫৪টি। বাংলাদেশে এখন এক হাজার ৫৮১ জনের জন্য একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক আছেন।

সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০৭টি। আর বেসরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। বাংলাদেশের এখন মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি?

২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে স্বাস্থ্যখাতের যন্ত্রপাতি কেনায়। ২৭টি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটার তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির এই চিত্র প্রকাশ করে?

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এক সেট পর্দার দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। ১৭৫ কোটি টাকার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য। রংপুর মেডিকেল কলেজে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও চার কোটি টাকার সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি?

২০১৭ সালে টিআইবির খানা জরিপে স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া ৪২.৫ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন?

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই (পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট) ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। যার জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকেও আমলে আনা হচ্ছে। এর পাশাপাশি এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করবে দুদক।

এছাড়া কমিশনের অভিযোগকেন্দ্র হটলাইন ১০৬ এ স্বাস্থ্যখাতের বেশকিছু কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলোর বিষয়েও কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিটকে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ কমিশন সার্বিক এসব কেনাকাটার বিষয়গুলো অনুসরণ করছে। এর বাইরেও বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post