ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ

মো. কামরুল হাসান :পেঁয়াজের বাজার নিয়ে বড় ধরনের কারসাজির অভিযোগ বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। গত ৩ দিন ধরে উড়োজাহাজে উড়িয়ে নিয়ে আসা মিসর ও তুরস্কের পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ করা হলেও দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। চড়াদামে পেঁয়াজ, লবণ, চালসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় করে মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে সর্বমহলে অভিযোগ উঠেছে। দ্রব্যমূল্যে পিষ্টে নিম্ন আয়ের মানুষের এখন নাকাল হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খোদ ব্যবসায়ীরাও বাজার নিয়ে চিন্তিত। তাদের ভাষ্য, অসাধু ব্যবাসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বাজারে অস্থিরতা দূর হচ্ছে না। এজন্য পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই। এদিকে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় পেঁয়াজ অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে বেশি মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থাটি পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি ও নৈরাজ্যের জন্য ৪৭ আমদানিকারককে চিহ্নিত করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ের কথা বলা হলেও কার্যত ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারছে না দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। অভিযোগ উঠেছে মনিটরিংয়ের নামে চলছে আইওয়াশ। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বরং দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
জানা গেছে, এই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। কারসাজি করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে শাস্তি নিশ্চিত করবে সরকার। ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টে শুধু সামান্য জরিমানা দিয়েই আর ছাড় নয়। সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে পেতে হবে বড় শাস্তি। কিভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়- সেই পরামর্শ নেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এ লক্ষ্যে গত রোববার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র উদ্যোগে একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি ফজলে ফাহিম জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর বছরব্যাপী চাহিদা, বাংলাদেশে পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তা মোকাবিলা করা হবে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
এদিকে পেঁয়াজের বাজার নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ৪৭ ব্যবসায়ীকে আজ-কাল জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা থাকলেও গতকাল সোমবার আমদানিকারক ১৩ জন ব্যবসায়ীকে এনবিআর কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে তারা কি জবাব দিয়েছেন সে ব্যাপারে এনবিআর’র পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। এর বাইরে এনবিআরের নজরদারিতে রয়েছে আরও ৩৪১ প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানিয়েছেন, অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় মজুদের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট করে অতিরিক্ত মুনাফা করা অন্যায় ও অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে এদের বিচার করা সম্ভব। এখন এদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
গতকাল সোমবার রাজধানীতে বসবাসকারী ক্রেতাদের এক কেজি দেশি পেঁয়াজ ২২০ টাকায় কিনতে হয়েছে। আর যেসব পেঁয়াজ মানুষ পছন্দ করে না বলে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতেন না, সেই চীন, মিসর ও তুরস্কের ঝাঁজহীন বড় বড় পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এই সময়ে পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৪০ টাকা। ফলে এখনকার এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম গত বছরের সাড়ে পাঁচ কেজির সমান। পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে গড়ে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগে। কেউ যদি খুচরা বাজার থেকে পাঁচ কেজি দেশি পেঁয়াজ কেনেন, তাহলে দাম পড়বে ১ হাজার ১০০ টাকা, যা দুই চুলার এক মাসের গ্যাস বিলের চেয়ে ১২৫ টাকা বেশি। আবার মোটামুটি এক মাসের বিদ্যুৎ বিলের সমান।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
ঝাঁজ কেবল পেঁয়াজেই নয়, চলতি মাসে ঢাকায় সরু চালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা, মাঝারি ৩ থেকে ৪ টাকা ও মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ২ টাকার মতো বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩ থেকে ৪ টাকা। আটার কেজি ১ থেকে ২ টাকা বাড়তি। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ টাকা। ডিমের ডজন ১০০-১০৫ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির গুজবে লবণ কিনতেও বাড়তি ব্যয় করে ফেলেছেন অনেকে।

জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে কাজ করছে সরকার। ভোজ্যতেল ও চিনি সিন্ডিকেটরা চিহ্নিত হয়েছে বেশ ক’বছর আগে। অসাধু এসব ব্যবসায়ী সরকারের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা ইতোমধ্যে করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এই তালিকায় রয়েছে চালকল মালিক, পাইকার ও আড়তদার ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মসলাজাতীয় পণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের অসাধু ব্যবসায়ীরা বরাবরই ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছর ধরে বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে পেঁয়াজ, রসুন ও আদা। আদা ও রসুন প্রায় সারা বছর ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। এখন প্রতি কেজি আদা ও রসুনজাত ও মানভেদে ১৬০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় উঠলে টনক নড়ে সরকারের। এখন দ্রুত পেঁয়াজ আমদানি ও উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচির কথা জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু পেঁয়াজের বাজার অস্থির করার পেছনে মূল কারসাজি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের। গোয়েন্দা সংস্থার হাতেও এর প্রমাণ রয়েছে। আর ওই প্রমাণের ভিত্তিতেই সম্প্রতি আড়াই হাজার ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যার অধিকাংশ পেঁয়াজ ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
জানা গেছে, ৪০ জনের একটি সিন্ডিকেট অখ্যাত ৯০ ব্যবসায়ীকে সামনে রেখে মুখে মুখে দাম নির্ধারণ করে আমদানি করা পেঁয়াজ পাইকারি মোকামে বিক্রি করেছেন সারাদেশে। সরকার আমদানির তথ্য ধরে অভিযান চালানোর শঙ্কা থাকায় অখ্যাত এ ব্যবসায়ীদের দিয়ে পেঁয়াজও এনেছেন শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। বার্মিজ পণ্যের আড়ালে অখ্যাত এ ব্যবসায়ীরা আমদানি করেছেন পেঁয়াজ। পেঁয়াজ কেনাবেচার তথ্য গোপন করতে পেপারলেস মার্কেটও তৈরি করেছেন তারা। এই মার্কেটের দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে দেশ
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কয়েক হাজার টন মজুদ পচা পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা সাগর ও নদীতে ফেলে দেন। মূলত বেশি মুনাফার আশায় এসব পেঁয়াজ মজুদ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রচ- দুর্গন্ধের কারণে পচা পেঁয়াজ বেশিদিন মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহজে এসব ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এদের শাস্তি দেয়ারও কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি সচিবালয়ে তিনি জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরকে ইঙ্গিত করে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানাসহ সব ধরনের শাস্তি দিন। আর ক্ষমা করা যায় না। অসাধু সিন্ডিকেট এসব ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post