Kbdnews ডেস্ক: বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের শহর মুঙ্গের একসময় ছিল উচ্চ বা মধ্যবিত্ত বাঙালিদের হাওয়া বদলের জায়গা। কিন্তু গত কয়েক দশকে সেই মুঙ্গের আরও বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে বেআইনি অস্ত্র তৈরির জন্য। ভারতে তো বটেই, মুঙ্গেরে তৈরি অস্ত্র পাচার হয় বাংলাদেশেও। এমনি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। ‘ভারতের মুঙ্গেরে তৈরি অবৈধ অস্ত্র যেভাবে ঢুকছে বাংলাদেশে’ শিরোনামে প্রকাশিত ঐ সংবাদে বলা হয়েছে, মুঙ্গেরে তৈরি বেআইনি অস্ত্র যে শুধু ভারতের দুষ্কৃতরা ব্যবহার করে তা নয়। এর একটা ভালো বাজার রয়েছে বাংলাদেশেও।
মুঙ্গের সমপ্রতি আবারও এসেছে সংবাদ শিরোনামে। মাস খানেক আগে সেখান থেকে পাওয়া গেছে ২০টি একে-৪৭ বন্দুক। জেলার পুলিশ সুপার বাবু রাম বলছেন, এই অস্ত্রগুলো জবলপুরের অর্ডিন্যান্স ডিপো থেকে আনা হয়েছিল। এছাড়াও ৩০টা ম্যাগজিন, পিস্তলও পাওয়া গেছে। একে-৪৭ গুলো পাওয়া গেছে একটা কুয়োর ভেতর থেকে। ২১ জনকে গ্রেফতার করেছি আমরা।
বাবু রাম আরও জানান, অস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে, আর লাইসেন্স প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণেও বেআইনি অস্ত্র কারবারিদের কাছ থেকে বন্দুক-পিস্তল কিনছে অনেকে।
বিবিসি বাংলার সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালী’র করা ঐ প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, মুঙ্গেরের একটি বৈধ বন্দুকের দোকানের মালিক ঠাকুর নরেশ সিং-এর কথায় এমন আভাস মেলে। তিনি বলছিলেন, তার দোকানে আগে বছরে শখানেক বা তার বেশি বন্দুক বিক্রি হতো। এখন বিক্রি হয় বছরে দু’তিনটি।
তবে এসপি বাবু রামের দাবি, আমাদের লাগাতার চাপের মুখে মুঙ্গের থেকে অনেক বেআইনি অস্ত্র কারবারি এখন পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খ-ে চলে গেছে।
গত কয়েক বছরে কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু অস্ত্র কারখানার হদিস পেয়েছে পুলিশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ বসবাসের বাড়ি ভাড়া নিয়ে কারখানা চালু করা হয়েছিল, কিন্তু কারিগর নিয়ে আসা হতো মুঙ্গের থেকেই।
একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মুঙ্গেরে পুলিশের চাপের ফলে নতুনভাবে কারবার ফাঁদছে অনেক বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়ী। যে রকম অস্ত্রের অর্ডার তারা পাচ্ছে, সেই অনুযায়ী মুঙ্গের থেকে কারিগর নিয়ে এসে কাজ শেষ হলেই আবার কারখানা তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তবে বেআইনি অস্ত্র তৈরির মূল ব্যবসা এখনও চলে মুঙ্গেরেই।
বিহার পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত মহানির্দেশক দেবকী নন্দন গৌতম একসময় মুঙ্গেরের পুলিশ সুপার ছিলেন।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, আমার মনে আছে, ১৯৮৬ সালে মুঙ্গেরের দিয়ারা এলাকায় একটা সার্চ অপারেশন চালিয়ে আমরা একে-৪৭ এর প্রায় ১০০ কার্তুজ উদ্ধার করেছিলাম। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ঐ একে-৪৭ সেই বছরেই চেকোসস্নাভাকিয়ায় তৈরি হয়েছিল। এক বছরের মধ্যেই তার গুলি পাওয়া গিয়েছিল মুঙ্গেরে। এদের নেটওয়ার্ক এতটাই সচল।
মুঙ্গেরে তৈরি সব অস্ত্রই যে বেআইনি তা নয়
ইংরেজ সরকার ১৮৭৮ সালে যে অস্ত্র আইন তৈরি করেছিল, সেই অনুযায়ী মুঙ্গেরসহ বিহারের বেশ কয়েকটি শহরে ২০ জনকে নিজেদের বাড়িতে অস্ত্র তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে নতুন অস্ত্র আইন আর তার ধারা অনুযায়ী সারাদেশে ১০৫ জন বন্দুক তৈরির লাইসেন্স পেয়েছিলেন। মুঙ্গেরের ৩৭ জন লাইসেন্স পেয়েছিলেন বন্দুক তৈরির।
এই বেসরকারি বন্দুক নির্মাতারাই ১৯৬২-র চীন ভারত যুদ্ধের সময় .৪১৯ বোরের মাস্কেট রাইফেল তৈরি করেছিলেন সেনাবাহিনীর জন্য। প্রায় ১০ একর এলাকা জুড়ে মুঙ্গেরে বন্দুক তৈরির কারখানা রয়েছে, যেখানে ১২ বোরের সিঙ্গল আর ডবল ব্যারেল বন্দুক তৈরি হয়। অন্যতম বন্দুক প্রস্তুতকারক সংস্থা ফাইজার গান ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির মালিক সৌরভ নিধি বলছিলেন, ২৫টা বন্দুক তৈরির কারখানার মধ্যে ৮টার অবস্থা বেশ খারাপ। দুটো তো বন্ধই হয়ে গেছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার একটি, মুঙ্গের বন্দুক নির্মাণ সহযোগ সমিতি লিমিটেড ভারতের একমাত্র বন্দুক কারখানা ছিল, যেটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল সমিতি রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী।
সৌরভ নিধি বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার বিহারের মোট ৩৭টি বন্দুক নির্মাণ সংস্থার জন্য বছরে ১২৩৫২টা ডবল আর সিঙ্গল ব্যারেল বন্দুক তৈরির কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সেই কোটা আজও চলছে।
কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় বছরে হাজার দুয়েক বন্দুক তৈরি হয়। একেকটা বন্দুক তৈরি করতে ৯ জন আলাদা আলাদা কারিগর দরকার হয়। এই যদি অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে বাকি কারখানাগুলোও খুব তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়ে যাবে।
একসময়ে মুঙ্গেরের বন্দুক কারখানাগুলোতে হাজার দেড়েক কারিগর কাজ করতেন। এখন সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে একশোর মতো।
কীভাবে মুঙ্গের অস্ত্র তৈরির মূল কেন্দ্র হয়ে উঠল
শহরের পুরোনো অস্ত্র নির্মাতা সংস্থা গিরিধারীলাল এন্ড কোম্পানির মালিক বিপিন কুমার শর্মার কথায়, মুঙ্গেরে অস্ত্র তৈরি হচ্ছে দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে।
তিনি বলেন, বাংলার নবাব মীর কাশিম আলি মুর্শিদাবাদ ছেড়ে তার রাজধানী সরিয়ে এনেছিলেন মুঙ্গেরে। সঙ্গে তার অস্ত্রাগারও নতুনভাবে এখানেই তৈরি হয়েছিল। নবাবের অস্ত্রাগারে কাজ করতেন অত্যন্ত কুশল কারিগররা। সেই কারিগরি বিদ্যা পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে।
তিনি বলছেন, এভাবেই মুঙ্গেরে এত ভালো বন্দুক তৈরির কারিগর রয়েছে। তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম অস্ত্র তৈরির কাজ করে চলেছেন। বৈধ বন্দুকের চাহিদা কমলেও অবৈধ কারবার ফুলে ফেঁপেই উঠছে।
মুঙ্গেরের চুরওয়া, বরহদ, নয়াগাঁও, তৌফির দিয়ারা, মস্তকপুর, শাদিপুর-এই সব গ্রামগুলোতে অবৈধ বন্দুক তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে কুটির শিল্পের মতো।এইসব অবৈধ কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়া পিস্তল, রিভলবার, রাইফেলের অর্থে বহু ঘরে উনুন জ্বলে। মনে করা হয়, অবৈধ কারখানাগুলোতে যেসব কারিগর কাজ করেন, তাদের অনেকেই একটা সময়ে হয়তো লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক কারখানাগুলোর শ্রমিক ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহানির্দেশক গৌতমের কথায়, যারা কাজ জানে, তাদের তো ব্যবহার করবেই কেউ না কেউ। বন্দুক তৈরির কুশলী কারিগরে এই অঞ্চলটা ছেয়ে রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র তৈরির কাজে টাকাও বেশি। তাই সরকারের উচিত এইসব শ্রমিকদের কারিগরি জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য এদের কোনও কারখানায় পুনঃনিয়োজিত করা যায় কীনা, সেটা ভেবে দেখা। অবৈধ কারখানাগুলোতে পুলিশ মাঝে মাঝেই তল্লাশি অভিযান চালায়। গত দু’বছরে প্রায় ৫০০ বেআইনি বন্দুক- যার মধ্যে দেশি-বিদেশি কাট্টা বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল- এসব বাজেয়াপ্ত করেছে। আবার অনেক সময়ে বন্দুকের নানা অংশও আলাদা করে খুঁজে পাওয়া গেছে তল্লাশির সময়ে।