তীব্র হচ্ছে ডলারের সঙ্কট

 ডলারের

মো. কামরুল হাসান : দেশের বাজারে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ডলারের সঙ্কট। একই সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় টাকার বিপরীতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ডলারের এই দাম বাড়ছে হু হু করে। গত বছরের জুন মাস থেকে দেশে ডলারের বাজারে যে সঙ্কট চলছিল তা যেন সহসাই শেষ হচ্ছে না, আর তাই ডলারের বর্ধিত দামের এই লাগাম টেনে ধরতে পারছে না কেউই। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জুলাই মাস শেষে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই দাম বেড়েছে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা। এর ভেতরেই আবার বাজারে কয়েক দিন আগে ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৩০ পয়সায়। আর সর্বশেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার (১০ মে) ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৮৫ দশমিক ৫০ টাকা। এদিকে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। সেই সঙ্গে কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী বছরের রিজার্ভের স্থিতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। ফলে নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যাওয়াও তাই হতে পারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। জানা গেছে, গত জুন মাস থেকেই দেশে ডলারের বাজারে সঙ্কট চলছে। এ থেকে উত্তরণে প্রতিদিনই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে সীমিত পরিসরে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে প্রায় দেড়শ কোটি ডলার। তার পরও শান্ত হচ্ছে না ডলারের বাজার। টাকার বিপরীতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৭৯ টাকা ৩০ পয়সা। এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতি ডলার কিনতে ব্যয় হয়েছে ৮২ টাকা ৯৪ পয়সা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই এক বছরের ব্যবধানে ডলার প্রতি দাম বেড়েছে ৩ টাকা ৬৪ পয়সা। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে আরও বেশি দামে। কোনো কোনো ব্যাংক আবার ঘোষিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। যদিও ৮৩ টাকার বেশি দামে ডলার বিক্রি না করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ভিন্ন রকম দরে ডলারের বেচা-কেনা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এবি ব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৮৫ দশমিক ৫০ টাকা, এনসিসি ব্যাংকে ৮৫ দশমিক ২৫ টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৮৩ দশমিক ৫০ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ৮৫ দশমিক ৫০ টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে ৮৩ দশমিক ১০ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম হওয়ায় এবং বৈশ্বিকভাবে চাহিদা বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে পারে। যে হারে খরচ হচ্ছে, আয় আসছে না সে হারে। তারা আরও বলছেন, নগদ অর্থকে নিরাপদে রাখতে হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে, তা পাচার কিংবা নিজেদের কাছে জমা করছে। ফলে হু হু করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। প্রচুর এলসির দেনা শোধ করতে হচ্ছে। তবে রফতানি ও রেমিট্যান্স খাত থেকে সে পরিমাণ আয় আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পণ্য ও সেবা খাতে প্রচুর পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে এক ধরনের টান সৃষ্টি হয়েছে ডলারের বাজারে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য আমদানিতে ৫ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল তিন হাজার ৫৬৭ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ২৮ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই আমদানি হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী যন্ত্রপাতি। অথচ এ খাতে আমদানি বাড়লেও শিল্প স্থাপন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার, যার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং (চালান), আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং, পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সাধারণত যে জিনিসের চাহিদা বেশি হয়, তার দাম বাড়ে। এখন বোঝা যাচ্ছে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ফলে দামও বাড়ছে। কিন্তু কেন চাহিদা বাড়ছে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেখতে হবে, আমদানি বাড়ছে কি না। তবে যে হারে ডলারের দাম বাড়ছে, সেই হারে আমদানি বাড়েছে না। তিনি বলেন, রফতানি বাড়লেও ডলারের দাম বাড়ে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে এখন রফতানি বাড়ছে- এমন চিত্রও চোখে পড়ে না। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলেও ডলারের দাম বাড়ে। তবে রেমিট্যান্স তো তেমন কমেনি, বরং এখন বাড়ছে। তাই এসব বিষয়ে বিবেচনা করলে সন্দেহ তৈরি হয়, হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে তা পাচার করছে অথবা জমা করছে। কারণ বিভিন্ন দিক চিন্তা করে অনেকে ডলার জমা করেও রাখতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post