স্টাফ রিপোর্টার : নৌ পরিবহণ অধিদফতরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হককে কারামুক্ত করার জন্য তার অনিয়ম-দুর্নীতির কতিপয় সহযোগী মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এজন্য তারা অন্তত ৫ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও তাদের সঙ্গে কয়েকটি ডিজাইন ফার্মের (জাহাজের নকশা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান) মালিকরাও রয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জাহাজের ২৯৪টি নকশা অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে; যার মধ্যে নাজমুল হকের অতি পছন্দের তিনজন নৌ স্থপতি বা ডিজাইনারেরই ১৬৪টি নকশা রয়েছে। জোরালো অভিযোগ উঠেছে, কারাবন্দি নাজমুল হকের ইঙ্গিতে ও অধিদফতরের প্রভাবশালী এক নারী কর্মকর্তার প্ররোচনায় নকশা শাখার তিন কর্মকর্তা অতি উৎসাহী হয়ে বাছাই কমিটিতে এই প্রশ্নবিদ্ধ তালিকা পাঠিয়েছেন। এছাড়া ঐ নারী কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আইনের ছাত্র হওয়ায় নাজমুল হককে মুক্ত করানোর জন্য নিয়মিত তার বাসায় যাতায়াত ও পরিচিত আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। নকশা শাখার উৎসাহী তিন কর্মকর্তা হলেন- উপ-পরিচালক শামীমউদ্দিন আহমেদ, কেমিস্ট শরিফুল ইসলাম ও কো-অর্ডিনেটর-২ রেজিনা বেগম। এরা সবাই নাজমুল হকের সব ধরনের অপকর্মের সহযোগী বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
এদিকে আগামী রোববার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নাজমুল হকের জামিন আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একাধিকবার নাকচ হওয়ার পর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন তিনি। গত ৩ মে আবেদনটি শুনানির জন্য উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী আদালতকে জানান, নাজমুল হক রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানির প্রস্তুতির জন্য সময়ের প্রয়োজন। দুদকের আইনজীবীর বক্তব্য আমলে নিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালত ১৩ মে শুনানির দিন ধার্য করেন। এছাড়া এর আগে নাজমুল হককে রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, নাজমুল হকের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলে পলাতক হতে পারেন অথবা মামলার আলামত নষ্টসহ তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারেন। তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাবন্দি রাখার আবেদন করেন তিনি। তবে জামিনের বিষয়ে নাজমুল হকের সহযোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাসহ কয়েকটি ডিজাইন ফার্মের মালিকরা এতোটাই আশাবাদী যে, তারা বলে বেড়াচ্ছেন- ‘এদিন জামিন হবেই এবং বিকালেই তিনি মুক্তি পাবেন। এরপর তিনি আবারো প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে বসবেন’। প্রকাশ্যে তাদের এ ধরনের দম্ভোক্তিতে অনেকের মাঝেই তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি বিস্ময় ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া নাজমুল হককে জামিনে মুক্ত করতে কয়েকজন নামি-দামি আইনজীবী নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের জন্য অন্তত ৫ কোটি টাকা তহবিল যোগাড়ের কথাও চাউর হয়ে গেছে বাজারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নাজমুল প্রতিটি জাহাজের নকশা অনুমোদনের জন্য আকার ও প্রকারভেদে ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতেন। এছাড়া নৌযানের মালিকানা পরিবর্তন, বে-ক্রসিংয়ের অনুমতি প্রদান, অভ্যন্তরীণ জাহাজের ড্রাইভারশিপ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে নিয়মিত প্রচুর টাকা ঘুষ নিতেন। তার বিরুদ্ধে এমন দুর্নীতির অভিযোগ সবার মুখে মুখেই শোনা যেতো। তিনি নিজে ছাড়াও ঘুষের টাকা আদায়ের জন্য কয়েকজন সহযোগীও ছিল তার। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এমন ৫ জনের নাম প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। নাজমুল হককে গ্রেফতারের পর তারা আত্মগোপন করেছেন। এই ৫ জন হলেন- নাজমুলের ভাতিজা (চাচাতো ভাইয়ের ছেলে) মো. মাসুদ রানা, আরেক চাচাতো ভাই মো. আবীর হোসেন, বাসার কেয়ারটেকার মো. আল আমিন, সাবেক ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. আলী রাজ এবং বিআইডবিস্নউটিএর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আলমগীর মামুন। এদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে বলে সূত্র জানায়।
সূত্র মতে, ইতোমধ্যে একাধিক ডিজাইন ফার্ম (জাহাজের নকশা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান) ও শিপিং কোম্পানি (জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান) নাজমুল হকের বিরুদ্ধে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম মোটা অংকের টাকা ঘুষ গ্রহণের তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করেছে। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপের কাছ থেকে একটি জাহাজের মালিকানা পরিবর্তনের জন্য ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌ পরিবহণ অধিদফতরে জমা হওয়া প্রায় ৩০০ নতুন জাহাজের নকশার মধ্যে অন্তত ১০০টির জন্য তিনি অগ্রিম ঘুষ নিয়ে রেখেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ঐ ১০০ নকশা প্রণয়নকারী ডিজাইন ফার্মগুলো নাজমুল হকের আশীর্বাদপুষ্ট। কিন্তু তারা টাকা দিয়ে ফেঁসে যাওয়ায় এখন বাধ্য হয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করছেন।
নাজমুল হকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে। তিনি দীর্ঘ দেড় বছর পর ২০১৬ সালে নাজমুলকে অব্যাহতির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করলে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দেয় এবং ২৪.০৫.২০১৬ তারিখ দ্বিতীয় দফায় উপ-পরিচালক হামিদুল হাসানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে। তিনি অনুসন্ধানকালে নাজমুল হকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী চেয়ে চিঠি দিলে নাজমুল হক সম্পদবিবরণী জমা দেন। এই কর্মকর্তাও এক বছর অনুসন্ধান করে তাকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশসহ প্রতিবেদনও নাকচ করে দেয় দুদক। কারণ নাজমুল হকের দাখিল করা সম্পদবিবরণীর সঙ্গে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে স্থাবর সম্পদেও যে মূল্য দেখানো হয়েছিল, তার প্রকৃত মূল্য অন্তত ১০ গুণ বেশি।