খুলনায় সহপাঠীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় জীবন দিতে হলো রাজিনকে

বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: সহপাঠীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটের ছুরিকাঘাতে জীবন দিতে হয়েছে খুলনা পাবলিক কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভীর রাজিনকে (১৩)। গত শনিবার রাত সোয়া ৯টায় কলেজ ক্যাম্পাসে কনসার্ট চলাকালে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। রাজিন হত্যাকান্ডে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন তার কলেজের শিক্ষক ও সহপাঠীরা। তারা হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ গত শনিবার রাতেই অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা নিহত রাজিনের সহপাঠী ও বন্ধু। এ ঘটনায় রাজিনের পিতা শেখ জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে রোববার নগরীর খালিশপুর থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ হত্যাকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। নিহত রাজিন খুলনা মহানগরীর বড় বয়রা ১২৮/৩, পালপাড়া সড়কের শেখ জাহাঙ্গীর আলম ও খুলনা মেট্রো পুলিশ লাইনস স্কুলের শিক্ষিকা রেহানা খাতুনের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, ফাহমিদ তানভীর রাজিন, তার মা’র সহকর্মী শিক্ষিকার মেয়ে মৌমিতা ও তৃষা একটি কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়তে যেত। কোচিংয়ে যাওয়া-আসার পথে মৌমিতা ও তৃষাকে একই এলাকার বখাটে ফাহিম ইসলাম মনি ও আসিফ প্রান্ত আলিফ উত্ত্যক্ত করতো। এতে রাজিন প্রতিবাদ করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার বখাটে মনির সঙ্গে রাজিনের বাগ-বিতন্ডা হয়। যার জের ধরে পাবলিক কলেজের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ দিন শনিবার রাত সোয়া ৯টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
সূত্র জানায়, শনিবার বিকেল ৫টার দিকে রাজিনের বন্ধু ও সহপাঠী শাহিনুর রহমান সাগর ফোন দিয়ে রাজিনকে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাত সোয়া ৯টায় ফাহিম ইসলাম মনি, তার বন্ধু আসিফ প্রান্ত আলিফ, রয়েল, সানি ইসলাম ওরফে আপন, জিসান খান ও তারিন হাসান রিজভীসহ ৭/৮ জন তাকে কনসার্ট স’লের পূর্বপাশে নিয়ে মারপিট করে। একপর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস’ায় দ্রুত তাকে কলেজ কর্তৃপক্ষ গাড়িতে তুলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাজিনদের প্রতিবেশী মোকলেছুর রহমান বলেন, রাজিন খুব ভদ্র একটি ছেলে ছিল। তার এ মৃত্যু আমরা মানতে পারছি না। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
সূত্র জানায়, নিহত রাজিনের মা রেহেনা বেগম খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্স্‌ হাইস্কুলের শিক্ষক। ওই স্কুলের অপর শিক্ষিকার মেয়ে ৭ম শ্রেণির ছাত্রী মৌমিতা। মৌমিতা, রাজিন ও সাবাব তিনজন সহপাঠী একই সাথে বিভিন্ন ব্যাচে কোচিং করত। নগরীর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার মোঃ ফাহিম ইসলাম মনি (১৩) রাজিনের সহপাঠী মৌমিতাকে বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করত এবং রাজিনকে মৌমিতার সাথে চলাফেরা ও কোচিং করতে নিষেধ করত। কিন’ রাজিন সেটা না করায় বিভিন্ন সময় ফাহিম তাকে হুমকি দিত। শনিবার রাত ৯টার দিকে খুলনা পাবলিক কলেজের রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠান চলাকালে স্টেজের পশ্চিম পাশে ফাহিম ও তার সহযোগিরা রাজিনকে ডেকে নিয়ে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে।
নিহত রাজিনের মা খুলনা মেট্রো পুলিশ লাইনস স্কুলের শিক্ষিকা রেহানা খাতুন আর্তনাদ করতে করতে বলেন, ‘বাবা তোমরা আমার রাজিনকে এনে দাও, সে তো কোনো বখাটে ছিল না? কোনো অপরাধ করেনি, তাহলে কেন তাকে এভাবে জীবন দিতে হলো?
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বাড়িতেই ছিল। বিকেল ৫টার দিকে তার সহপাঠী ও বন্ধু শাহিনুর রহমান সাগর তাকে কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য ফোন দেয়। তার ফোন পেয়েই আমার রাজিন বাসা থেকে বের হয়। রাত সোয়া ৯টায় সাগরই আবার আমাকে ফোন দিয়ে তাকে ছুরি মারার খবর দেয়।
তিনি বলেন, রাজিন আমার সহকর্মী শিক্ষিকার মেয়ে মৌমিতা ও তৃষার সঙ্গে একই কোচিং সেন্টারে পড়তে যেত। কোচিংয়ে যাওয়া-আসার পথে মৌমিতা ও তৃষাকে একই এলাকার বখাটে আলিফ ও তার বন্ধুরা উত্ত্যক্ত করতো। এর প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। রাজিনের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সাগরের ডেকে নেওয়ার সম্পৃক্ততাও রয়েছে। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। ‘কিশোর অপরাধী’র নামে তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া না হয়। আমার ছেলেও একজন কিশোর। এ কথা বলতে বলতেই তিনি মূর্ছা যান।’
খুলনা পাবলিক কলেজের কেয়ারটেকার সেনাবাহিনীর অব. ল্যান্স কর্পোরাল মো. মোসলেম উদ্দিন জানান, কলেজে কনসার্ট চলছিল। রাত সোয়া ৯টার দিকে কলেজের দ্বিতীয় গেটের ১০-১২ গজ ভেতরে ও অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে চিৎকার শুনে তিনি ঘটনাস’লে এগিয়ে আসেন। এ সময় তিনি রাজিনকে রক্তাক্ত অবস’ায় দেখতে পান। রাজিন ‘আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করার সময় তিনি তাকে ধরে দেখতে পান তার বুকের বাম পাজরে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তার ধারণা রাজিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
খবর পেয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া, জেলাপ্রশাসক আমিন উল আহসান, কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) আব্দুল্লাহ আরেফ হাসপাতাল ও নিহতের বাড়িতে যান। এদিকে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে ও ঘটনাস’লের পাশে দায়িত্ব পালনরত অবস’ায় চারজন পুলিশ সদস্য থাকলেও কীভাবে ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ঘাতকরা কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করলো এনিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
খুলনা পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কলেজের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস’া নেওয়া হয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস’াও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। এছাড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস’াও ছিল। প্রথমদিন অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে শেষ হলেও শেষ দিন এমন একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। তিনি বলেন, রাজিন অত্যন্ত মেধাবী ও ভদ্র ছাত্র ছিল। তার এ অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তিনি জানান, এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তারা হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আগামীকাল মঙ্গলবার কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের তিনি অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এমনকি ঘটনার সঙ্গে যদি কলেজের কোনো শিক্ষক বা ছাত্রের সংশ্লিষ্টতা থাকে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস’া গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ শনিবার রাতেই বিভিন্ন স’ানে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে আটক করে। আটককৃতরা হচ্ছে- নগরীর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও সেনা সদস্য আলমগীর হোসেনের ছেলে আসিফ প্রান্ত আলিফ (১৬)। আলিফের পিতা বর্তমানে কঙ্গোয় শান্তি মিশনে রয়েছেন। এছাড়া অন্যরা হচ্ছে- নগরীর বড় বয়রা মেইন রোডস’ আফজালের মোড় এলাকার জাকির হোসেন খানের ছেলে মো. জিসান খান ওরফে জিসান পারভেজ (১৬), বড় বয়রা মেইন রোড এলাকার মো. আহাদ হোসেনের ছেলে তারিন হাসান ওরফে রিজভী (১৩), রায়েরমহল মুন্সিবাড়ির চিনির ভাড়াটিয়া সাইদ ইসলামের ছেলে মো. সানি ইসলাম ওরফে আপন (১৩), বড় বয়রা সবুরের মোড় এলাকার লিয়াকত হোসেনের ছেলে রয়েল (১৪) এবং মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও মোংলা থানার এসআই ওহিদুর রহমানের ছেলে শাহিনুর রহমান ওরফে সাগর (১৩)। তবে আটকদের মধ্যে সাগর ছাড়া অন্যদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। এছাড়া এ মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে মুজগুন্নী আবাসিক এলাকার ফারুক হোসেনের ছেলে মো. ফাহিম ইসলাম মনিকে। আসামিদের মধ্যে মনি পলাতক রয়েছে।
খালিশপুর থানার ওসি (তদন্ত) আবুল খায়ের বলেন, নিহত রাজিনের পিতা শেখ জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জনকে আসামি করে এজাহার দাখিল করেছেন। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ৫ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
খালিশপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম আল বেরুনী বলেন, মৌমিতাকে কেন্দ্র করে ফাহিমের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজিনকে হত্যা করেছে। ফাহিম পলাতক। বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করে সন্দেহজনকভাবে পুলিশ ও র‌্যাব ৬ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
এদিকে, গত রোববার দুপুরে পোস্টমর্টেম শেষে রাজিনের লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বয়রা মধ্যপাড়া জামে মসজিদে বাদ জোহর এবং বেলা ৩টায় কলেজ ক্যাম্পাসে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাদ আছর পাইকগাছা উপজেলার হিতামপুর গ্রামে পুনরায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস’ানে নিহতের লাশ দাফন করা হয়।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post