.,mবীজের দাম বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করেছে বিএডিসি

কুষ্টিয়া থেকে শরিফ মাহমুদ  : সিন্ডিকেটের সাথে পালস্নাদিয়ে সকল প্রকার বীজের দাম বৃদ্ধি করেছে দেশের কৃষি সেক্টরের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। ৩৫ টাকার বোরো ধান এবং ৩৪ টাকার গম বীজের দাম বাড়িয়ে ৫০ টাকা কেজি করা হয়েছে। এছাড়াও সকল প্রকার সবজী ও ডাল-তৈল বীজের দাম কেজিপ্রতি বাড়ানো হয়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যনত্ম। সেবামুলক খাত হিসেবে দীর্ঘ ৫৬ বছর বিএডিসি মানসম্মত বীজ অধিকহারে উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে কৃষকদের নিকট সরবরাহ করে আসছে। অতীতে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নাম থাকলেও বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সময় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের সফল কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর অক্লানত্ম পরিশ্রমে গত আট বছর বিএডিসি তাদের উৎপাদিত বীজ ও আমদানীকৃত নন-ইউরিয়া সার স্বল্পমূল্যে কৃষকদের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে সড়্গম হয়েছে। তবে হঠাৎ করে সকল প্রকার বীজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি আবারো প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কৃষকদের অভিযোগ, বর্তমানে দেশে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ধান ও চালের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। দাম বাড়ার এই অস্বাভাবিক হার চাল প্রতিকেজি ৫ থেকে ৬ টাকা আর ধান মনে ২’শ থেকে ৩’শ টাকা। সেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে ছাড়িয়ে গেছে খোদ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান বিএডিসি। তারা দাবী করেন, দেশে এমন কোন ভয়াবহ পরিসি’তি তৈরী হয়নি, যে এক লাফে বীজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। এমনকি গত আমন মৌসুমে বীজের তীব্র সংকট দেখা দিলেও এতো দাম হয়নি। বিএডিসির ডিলারদের দাবী সংগ্রহের সময় বাজার ছাড়া অতিরিক্ত দামে বীজ ক্রয় করায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষককূল ও সরকার যখন ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাসত্মবায়নে ব্যসত্ম, ঠিক তখন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বিএডিসি বীজের নির্ধারিত দাম প্রায় দ্বিগুণ করে কৃষকদের শেষণের চেষ্টা করছে বলে মতপ্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। দেশের বর্তমান দুর্যোগময় পরিসি’তে বীজের দাম না বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গত ৯ আগষ্ট বিএডিসির মহাব্যবস’াপক (বীজ) নূর মোহাম্মদ মন্ডল স্বাড়্গরিত বোরো ধান, গম সবজী ও সকল প্রকার তৈল বীজের দাম বৃদ্ধি সংক্রানত্ম মূল্য তালিকা পত্র দেশের সকল বীজ বীপনন অফিসের উপ-পরিচালক বরাবর প্রেরণ করা হয়। এরপর থেকে দেশজুড়ে ডিলার ও কৃষকদের মধ্যে শুরম্ন হয় তোলপাড়।
বিএডিসি সুত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রত্যায়িত জাতের বোরো ধান বীজ প্রতিকেজি ৩৫ টাকা এবং ভিত্তি ধান বীজের মূল্য ছিল ৪০ টাকা। একই জাতের ধান বীজ ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রত্যায়িত ৫০ টাকা এবং ভিত্তি ৫৮ টাকা কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রত্যায়িত জাতের গম বীজ প্রতিকেজি ৩৪ টাকা এবং ভিত্তি ধান বীজের মূল্য ছিল ৪২ টাকা। একই জাতের গম বীজ ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রত্যায়িত ৫০ টাকা এবং ভিত্তি ৬২ টাকা কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। ডাল-তৈল বীজের মধ্যে ৫৮ টাকা কেজির মুগ বীজ ৯৪ টাকা, ৮০ টাকা কেজির মাসকালাই ৯০ টাকা, ৪৮ টাকা কেজির খেসারী ৬৮ টাকা, ৬৬ টাকা কেজির ছোলা ৯৮ টাকা, ৫৮ টাকা কেজির মটর ৯৬ টাকা, ৫৪ টাকা কেজির সয়াবিন ৬৮ টাকা, ৪৫ টাকা কেজির তিল ৬৮ টাকা এবং ৮৪ টাকা কেজির চিনা বাদাম ৯৬ টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও সবজী বীজের মধ্যে ১৩০০ টাকা কেজির রতন টমেটো বীজের দাম করা হয়েছে ১৪১৫ টাকা, ১২০০ টাকা কেজির পুষারম্নবি টমেটো ১৩৬০ টাকা, ১৬০ টাকা কেজির মুলা ১৮০ টাকা, ৯০ টাকা কেজির পালং শাক ১১০ টাকা, ২৬০ টাকা কেজির লাল শাক ২৮০ টাকা, ১৬০ টাকা কেজির আরএম শাক ১৮০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও গ্রীস্মকালীন সবজীসহ বিএডিসির সকল প্রকার বীজের মূল্য কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যনত্ম।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঢাকা-ঝালুপাড়া এলাকার কৃষক তারেক হাসান সাগর বলেন, বীজের দাম বাড়িয়ে সরকার আমাদের মতো ছোটখাট কৃষকদের শোষণ করতে যাচ্ছেন। গত মৌসুমে বিএডিসির ১০ কেজির ধানের বসত্মা কিনেছিলাম ৩৫০ টাকায়। দাম বাড়লে না হয় ৪০০ টাকা হতে পারে। তাই বলে ৫০০ টাকায় ১০ কেজি সরকারী ধান বীজ কিনতে হবে এটা হতে পারে না।
বিএডিসির মহাব্যবস’াপক (বীজ) নূর মোহাম্মদ মন্ডল জানান, কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম বেড়েছে। তাই চুক্তিবদ্ধ চাষীদের কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে বীজ কিনতে হচ্ছে। প্রসেসিং থেকে শুরম্ন করে প্যাকেজিং পর্যনত্ম শ্রমিকের মজুরি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছে পরিবহণ খরচ। সব ড়্গেত্রেই খরচ বাড়ার কারণে বীজের দাম কিছুটা বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। দাম বাড়ালেও আমাদের কোন লাভ নাই, এরপরেও লোকসান থাকবে।
তবে বিএডিসির কর্মকর্তাদের সাথে একমত না, ডিলার ও কৃষকরা। ডিলারদের দাবী, বিএডিসি বীজের ক্রয় মূল্য বাড়িয়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা। অথচ বিক্রয় মূল্য বাড়িয়েছে ১৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যনত্ম। বর্তমানে বিএডিসি সেবামূলক খাত থেকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএডিসির এক বীজ ডিলার জানান, গত বছর চুক্তিবদ্ধ চাষীদের কাছ থেকে ৩২ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে ক্রয় করা বোরো প্রত্যায়িত জাতের ধান বীজ এবছর বিএডিসি ক্রয় করেছে ৩৯ টাকায়। কেজিতে এই ধান বীজ সাড়ে ৬ টাকা বেশি দরে ক্রয় করে দাম বাড়িয়েছে ১৫ টাকা। একই অবস’া গম বীজের ড়্গেত্রে। গত বছর চুক্তিবদ্ধ চাষীদের কাছ থেকে ৩৩ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে ক্রয় করা গম বীজ এবছর বিএডিসি ক্রয় করেছে ৩৫ টাকায়। কেজিতে এই গম বীজ দেড় টাকা বেশি দরে ক্রয় করে দাম বাড়িয়েছে ১৬ টাকা।
সুত্রের দাবী, সারাদেশে বিএডিসির ১৫ ক্রয় কেন্দ্র ও ১০টি অধিক বীজ ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ চাষীদের নিকট থেকে বীজ ক্রয় করে থাকেন। নামে চুক্তিবদ্ধ কৃষক হলেও ১৫ ক্রয় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রনে আছেন এলাকাভিত্তিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। এসকল নেতা ও প্রভারশালীদের সাথে যোগসাজস রয়েছে কৃষি ভবনের কয়েকজন কর্মকর্তার। মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় ওই সকল কর্মকর্তারা বাজার ছাড়া অতিরিক্ত দামে বীজ সংগ্রহের প্রসত্মাব করেন। গত কয়েক বছর যাবত এর প্রমাণও মিলেছে।
এ বছর অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে মাঠের পর মাঠ ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। ড়্গতিগ্রসত্ম হয়েছে কয়েক লাখ কৃষক। তারপরও যদি সরকার বীজের মূল্য এভাবে দ্বিগুণ করে, তাহলে দেশের খাদ্য জোগানদাতা কৃষক কোথায় দাঁড়াবেন প্রশ্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসাইনের। তিনি বলেন, দেশের কৃষি সেক্টরের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএডিসির অন্যতম কাজ হচ্ছে কৃষিড়্গেত্রে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। বর্তমানে দেশের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা বন্যা কবলিত। সেখানকার কৃষকরা অত্যনত্ম কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। বর্তমান পরিসি’তিতে কৃষি সেক্টর বিপর্যসত্ম অবস’ায় আছে। সরকার বন্যা কবলিত এলাকায় নানা উদ্যোগ গ্রহন করছে এবং কৃষিড়্গেত্রে কৃষকদের সকল ধরণের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। ঠিক সেই মুহুর্তে বিএডিসি অস্বাভাবিকহারে বীজের দাম বাড়িয়ে কৃষকদের শোষণ করতে চাচ্ছেন। দেশের দূর্যোগময় পরিসি’তির কথা বিবেচনা করে বিএডিসির যথাযথ ভুমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক। কৃষক ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এব্যাপারে সংশিস্নষ্ট মহলকে এখনই যথাযথ ব্যবস’া গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় এর জন্য কৃষি সেক্টরকে বিরাট মাশুল দিতে হবে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post