গাংনীর ঘরছাড়া এক সুরের পাগল ওস্তাদ রতন সরকার



                                                         ছবি: আমিরুল ইসলাম অল্ডাম

আমিরুল ইসলাম অল্ডাম :মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি ঃ বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লী মেহেরপুর জেলার গাংনীর উপজেলার একটি গ্রাম নিত্যানন্দপুর। যে গ্রামের মানুষ আনন্দে মেতে থাকে সব সময়। বাংলার আর দশটা গ্রামের মতই সুজলা- সুফলা, শস্য-শ্যামলা পাখি ডাকা আনন্দে মাতোয়ারা এ গ্রামের সবুজ প্রান্তর। খৃষ্টান অধ্যুষিত ছোট্ট একটি গ্রামের নামের সাথে সাংঘাতিক মিল রয়েছে গ্রামটির। সুর পাগল একটি মানুষষের কারনে আনন্দ-উৎসব, নাচ-গান, যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। হ্যাঁ, দর্শক, আপনারা হয়তো এতক্ষণ জেনে গেছেন, আমি কার কথা বলছি। আপনাদের ধারণায় ঠিক। এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছেন প্রকৃতি প্রেমিক, সুরের পাগল ওস্তাদ রতন সরকার। গ্রামের প্রকৃতি তার কাছে খুব ভাল লাগার একটি জায়গা। ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকে তিনি পাখির কুজন, গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি, বাতাসের কম্পন,বাতাসে ফসলের মন মাতানো ঢেউয়ের মাঝে তিনি খুঁজে বেড়াতেন সুর।সঙ্গীতের সেই সুরের মুর্ছূনা অন্বেষন থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন  সুর ও সঙ্গীত পাগল ওস্তাদ রতন সরকার। তিনি শুধু তার পরিবারে নয়। উপজেলা-জেলা ছাড়িয়ে দেশের সবখানে শাস্ত্রীয় ও  লোকজ সুরের রেশ ছড়িয়ে দিতে আজও কাজ করে যাচ্ছেন। 

সেই সুর ও সঙ্গীত পাগল ওস্তাদ রতন সরকার সঙ্গীত নিয়ে বলেছেন,সঙ্গীত শেখার কোন শেষ নেই। শিখতে শিখতে বুড়ো হয়ে গেলাম।আমি আজও শিখছি।সঙ্গীতের নেশায় আমার বেশীদূর লেখাপড়া হয়নি।  আমার মধ্যে যেটুকু আছে আমি সবাইকে বিলিয়ে দিতে চাই।তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে আরও বলেন ,গান গাওয়া সহজ।গায়ক হওয়াও খুব সহজ। কিন্তু শিল্পী হওয়া সহজ না।নিজের মধ্যে শিল্পী সত্ত্বা সৃষ্টি করা দরকার।শিল্পী হতে হলে শিল্পমনা মানুষ হতে হয়। তার মধ্যে সাহিত্য রস থাকতে হয়।

ওস্তাদ রতন সরকার আরও বলেন, আমি সুর ও সঙ্গীত শিখতে ছোট বেলা থেকেই ঘর ছেড়ে দূর-দূরান্তরে চলে গেছি। বাড়ীর লোকজনের অগোচরে অনেকদিন গান ও যন্ত্র বাজানো শিখতে হারিয়ে যেতাম। কিশোর বয়স থেকেই পারিবারিকভাবে ৩ জন শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত  সরকার নামের দাদার কাছে, বাবা শৈলেন্ সরকারের কাছে, কাকা দিলিপ সরকারের কাছে সঙ্গীতে হাতে খড়ি হয় ওস্তাদ রতন সরকারের।তিনি স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলেন, আমি সঙ্গীত শিখতে সাইকেল চড়ে, পায়ে হেটে আমার গ্রাম  থেকে মেহেরপুরের মুজিবনগরের রামনগর-বল্লভপুরের মোঃ আলম মাষ্টারের কাছে ১০ বছর যাবৎ হারমোনিয়াম, তবলা ,গাংনী উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের আঃ কাদের আলী বিশ্বাসের কাছে ৩ বছর যাবৎ বাঁশী শিখেছি। চুয়াডাঙ্গার তিতুদহ গ্রামের ওস্তাদ হযরত আলীর কাছে ৬ বছর যাবৎ কর্নেট, খালিশপুরের ওস্তাদ নূরু মিয়া কাছে ৭ বছর যাবৎ ফ্লুট বাঁশী, ওস্তাদ তাহাজ্জত মাষ্টারের কাছে (নাসির ওয়েল মিলের পিছনে) ৬ বছর যাবৎ কর্ণেট তালিম নিয়েছি। চুয়াডাঙ্গার আনছারবাড়ীয়া- আন্দুলবাড়ীয়া গ্রামের মাষ্টার মাদু সেখের কাছে রাগ, কার্পাসডাঙ্গার যুগল বাবুর কাছে খোল,জুগিন্দা জুয়েল মল্লিকের কাছে খোল, নান্দবার-বড়গাংনীর ওস্তাদ পঞ্চানন বাবুর কাছে খোল, মেহেরপুরের গোপাল চন্দ্র কর্মকারের কাছে খোল, পিরোজপুরের ওস্তাদ পদ ঘোষের কাছে খোল বাজানোসহ কুষ্টিয়ার আব্দুল মোতালেব মাষ্টারের কাছে আমি ২ বছর যাবৎ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছি। জীবনে অনেক ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছি। 

জীবনের একটা বিশাল অংশ তিনি সঙ্গীত শিক্ষার মধ্য অতিবাহিত করেছেন। না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থেকে শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য পেতে দিনের পর দিন কষ্ট করেছেন।একের পর এক  শিক্ষাগুরুর শিষ্যত্ব নিয়ে সঙ্গীতের সাধনা করেছেন।তিনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন একতারা,দোতারা,সেতার,ঢোল,খোল,ঢুগী,তবলা, বাঁশের বাঁশী,হারমোনিয়াম,নাল, প্রেমজুড়ি,গিটার, পিয়ানো ইত্যাদি বাজানো শিখে ক্ল্যাসিকধর্মী, রাগপ্রধান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চ্চা করেন।ঐ সময় থেকেই তিনি জারি, সারি, বাউল, লোকসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ,কীর্তন গানের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন।তিনি কণ্ঠ সঙ্গীতের সাধনা ছেড়ে যন্ত্র সঙ্গীতে সাধনায় জড়িয়ে পড়েন।

এই সঙ্গীত ও সুরের সাধক ওস্তাদ রতন সরকার ১৯৪৫ সালের ১লা জানুয়ারী গাংনী উপজেলার নিভৃত পল্লী নিত্যানন্দপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৮ বছর।এই বয়সেও তিনি চির তরুণ,চির যুবক।সহধর্মিনী অঞ্জলী সরকার একজন রতœগর্ভা মা। ওস্তাদ রতন সরকার ব্যক্তিগত জীবনে ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তানের জনক।দুই ছেলে থমাস ও শীতল সরকার বাবার মত সঙ্গীত জগতে রয়েছে।

এই কিংবদন্তী সঙ্গীত সাধককে সম্মান জানাতে ২০০৭ সালে তৎকালীন গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হামিদুল হক গাংনী উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত করেন। এসময় ওস্তাদ রতন সরকার কে একাডেমির ওস্তাদ হিসাবে নিয়োগ দেন। গাংনী উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় দিবসগুলো (বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, জাতীয় শোক দিবস, ডিজিটাল মেলা, উন্নয়ন মেলা ), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যু দিবস,বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিবস,জাতীয় পুরস্কার  প্রতিযোগিতা ,লালন উৎসবসহ নানা  দিবস  উদযাপনে যথাযথভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।এই আমাদের ওস্তাদ রতন সরকার। গাংনীর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে যিনি নতুন মাত্রা ও শুদ্ধ সঙ্গীতের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি গাংনী শুধু নয় মেহেরপুর জেলায় অসংখ্য শিক্ষানবীশকে সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে গড়ে তুলেছেন। যোগ্য শিষ্য তৈরী তাঁর এক বিশাল কীর্তি।সফল শিষ্যদের মধ্যে রয়েছে, চিৎলা গ্রামের গোলাম আম্বিয়া, জুগিন্দা গ্রামের বাবু সুকেশ চন্দ্র বিঃ, মহেশপুর গ্রামের আরশিদা আক্তার সুমী (শবনম মুস্তারী),ভাংবাড়ীয়ার ক্ল্ােজ আপ ওয়ান সেরা কন্ঠ শিল্পী বিউটি, গাংনীর ফারহানা কানিজ তথাপি, তেঁতুলবাড়ীয়ার আশরাফ মাহমুদ, গাংনীর স্বপ্না রানী  বিশ্বাস, গাংনীর মাহবুবা আক্তার বিউটি,নিত্যানন্দপুরের থমাস সরকার,জুগিন্দার লরেন মন্ডল,মনোহরপুরের জালালউদ্দীন,গাংনীর হামিদুল ইসলাম,সাহারবাটির রবিউল ইসলাম পটল,চৌগাছার মুস্তাফিজুর রহমান, চিৎলার নান্টু সরকারসহ অসংখ্য শিষ্য গড়ে তুলেছেন। যারা বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হিসাবে জায়গা করে নিয়েছ্ েএবং বাংলাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী হিসাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে নাম কুড়িয়েছেন। এছাড়াও তিনি অভিভাবকদের বিশেষ অনুরোধে নাম মাত্র সম্মানীতে বাড়ী বাড়ী  গিয়ে টিউশনি করে শুদ্ধ স্বরলিপিসহ সঙ্গীত শিখিয়ে থাকেন।বর্তমানে তাঁর একজন সুযোগ্য শিষ্য সেলিম রেজা উপজেলা শিল্প কলা একাডেমিতে সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গাংনীর সাংস্কৃতি চর্চ্চাকে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং জেলা পর্যায় এমনকি বিভিন্ন বেসরকারী সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে একাধিক পদক, সম্মাননা ক্রেষ্ট উপহার পেয়েছেন। ইতো মধ্যেই মেহেরপুর জেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গাংনী উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।  এসব দুর্লভ সম্মান ও খেতাব সঙ্গীত বিদ্যায় শিক্ষক ওস্তাদ রতন সরকারের অসাধারণ কীর্র্তি ও সাফল্যকেই সূচিত করে। 

এই কিংবদন্তী সদালাপী সঙ্গীত সাধক ওস্তাদ রতন সরকার আরও অনেকদিন আমাদের মাঝে জীবিত থাকুন। সুস্থ থাকুন এই প্রত্যাশা করি।





Post a Comment

Previous Post Next Post