habebur Rahman : করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাসজনিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বেড়েছে উদ্বেগ। এর আগে ভারতে বস্ন্যাক ফাঙ্গাস ও হোয়াইট ফাঙ্গাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলেও এবার ইয়েলো ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয়েছে। সম্প্রতি মিউকোরমাইকোসিস বা বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে একজন রোগী বারডেম হাসপাতালে মারা গেছেন। বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত একজন রোগী এখনো বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত অন্য এক রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন।
বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় সর্বত্রই এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ভারতে ছড়িয়ে পড়া বস্ন্যাক, হোয়াইট ও ইয়েলো ফাঙ্গাস যাতে বাংলাদেশে না ছড়াতে পারে সেজন্য সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। একই সঙ্গে একটি গাইডলাইনও তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আতঙ্ক না ছড়িয়ে সতর্ক হতে বলেছেন।
জানা গেছে, দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করোনা মহামারীর মধ্যে ভয় জাগাচ্ছে বস্ন্যাক ফাঙ্গাস। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বস্ন্যাক, হোয়াইট ও ইয়েলো ফাঙ্গাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশেও কিছুদিন ধরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কারণ এই ফাঙ্গাস আক্রান্ত হওয়ার পেছনে করোনার ভারতীয় নতুন ধরনকে দায়ী করা হচ্ছে। করোনার ভারতীয় ধরনে সংক্রমিত রোগী বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ধরনটি ছড়িয়ে পড়ার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে। তবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বাড়ছে। ভারতীয় ধরন যাতে দেশব্যাপী ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য সতর্ক রয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে উচ্চ সংক্রমিত সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইতোমধ্যে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী অন্য জেলাগুলোর বিষয়েও খোঁজখবর রাখছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করা দুজন বাংলাদেশি নাগরিক বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের একজন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে মৃত্যুর খবর গত মঙ্গলবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর খবর স্বীকার করে বলেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই রোগী বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন। তবে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসের আরো একজন রোগী এখনো বারডেম হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও আরেকজন পালিয়ে গেছেন। বারডেম হাসপাতাল থেকে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগী পালিয়ে যাওয়ায় সর্বত্রই এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে বাংলাদেশে একজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে তিনি বস্ন্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ভারতে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসের যে সংক্রমণ হচ্ছে, বাংলাদেশেও এটি শনাক্ত হয়েছে। সবাইকে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আতঙ্কের কিছু নেই। অপরদিকে, রাজশাহীতে আতংক ছড়াচ্ছে মিউকোরমাইকোসিস বা বস্ন্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক। ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসে একজন আক্রান্ত হয়েছেন। এ থেকে চিকিৎসকরা মনে করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেহেতু এই ভাইরাস ধরা পড়েছে সেহেতু সতর্ক না হলে বস্ন্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন বা কালো ছত্রাক রাজশাহীতে আসতেও খুব বেশি দেরি হবে না। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা দিয়ে হু হু করে মানুষ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষে সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে নিরাপত্তাকর্মীরা। বিশেষ করে বস্ন্যাক ফাঙ্গাস এখন থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাজশাহীর অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ। এখন থেকেই সতর্ক না হলে এই ভাইরাসও করোনার মতোই মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। সূত্র জানায়, মিউকোর বা রাইজোপাস ফাঙ্গাসের মাধ্যমে এই সংক্রমণ হয়ে থাকে। এই ফাঙ্গাস সাধারণত মাটি, গাছ, সার, পচা ফল এবং সবজিতে পাওয়া যায়। এই ফাঙ্গাস সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে প্রভাব ফেলে। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই ফাঙ্গাসের কারণে পরিপাকতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বলে জানা গেছে। এই ধরনের সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে চোখ বা চোয়াল অপসারণেরও প্রয়োজন হতে পারে। এই ফাঙ্গাস ফুসফুস বা পরিপাকতন্ত্র আক্রমণ করলে তা শনাক্ত করা কঠিন, কারণ তখন উপসর্গগুলো দেরিতে প্রকাশিত হয়। এর মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ। নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত বা কালো তরল নির্গত হওয়া, মাথা ব্যথা, চোখ ফুলে যাওয়া বা ব্যথা, চোখের পাতা খসে পড়া, চোখে ঝাপসা দেখা এবং শেষ পর্যন্ত অন্ধত্ব। এছাড়া নাকের আশেপাশে কালো ছোট দাগ দেখা যেতে পারে এবং নাকের চারপাশে অসাড়তা তৈরি হতে পারে। ফুসফুসে সংক্রমণের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যেসব রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যাদের দীর্ঘসময় আইসিইউতে থাকতে হয়েছে, তাদের মধ্যে এই ধরনের ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। সংক্রমণের ক্ষেত্রে জিহ্বায় সাদা ছোপ দেখা যায়। এই সংক্রমণ যকৃত ও ফুসফুসে হয়ে থাকে। এটি মিউকোরমাইকোসিসের মতো ভয়াবহ নয়। এই সংক্রমণে মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় ১০ ভাগের মতো। সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে গেলে এই ধরনের সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এই ধরনের ফাঙ্গাসজনিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুবই জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের ধুলাবালির কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। এদিকে, দিনাজপুরের
সীমান্তবর্তী এলাকা হিলিতে বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণের হার। আটকেপড়া ভারত ফেরত একজনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এতে করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ। তবে সংক্রমণ রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, মিউকরমাইসিটিস ছত্রাক থেকে মিউকরমাইকোসিস হয়ে থাকে। এটি বাতাসের চেয়ে মাটিতে এবং শীত ও বসন্তকালের চেয়ে গ্রীষ্ম ও শরৎকালে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন এই আণুবীক্ষণিক ছত্রাকের স্পোরের সংস্পর্শে আসে। সুতরাং এই মিউকরমাইসিটিসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। তবে, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই ছত্রাক ক্ষতিকর নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে মিউকরমাইসিটিসের স্পোর প্রবেশ করলে ফুসফুস ও সাইনাস আক্রান্ত হতে পারে। যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বিরল ছত্রাকে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। তবে ৯২৯টি ঘটনা নিয়ে করা ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে মৃত্যুহার ৫৪ শতাংশ। সব বয়সী মানুষের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি না থাকায় এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। কোভিড-১৯ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী, যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন, ক্যান্সার আক্রান্ত অথবা যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাই নয়, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কারণেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে গত ২৬ এপ্রিল দু’দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। তিন দফায় ‘সীমান্ত বন্ধ’ সিদ্ধান্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। ৩১ মে পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধ থাকবে। কাগজে-কলমে সীমান্ত বন্ধের এই নির্দেশনা জারি করা হলেও প্রতিদিন ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে মানুষ আসছেন। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের অনেকের শরীরে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পাশাপাশি বস্ন্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়াও মালামাল নিয়ে যেসব ট্রাক সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাতায়াত করছে; সেগুলোর ড্রাইভারদের কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে মানা হচ্ছে না। ভারত ঘুরে যেসব বাংলাদেশি ট্রাক ড্রাইভার সাতক্ষীরার ভোমরা, যশোরের বেনাপোল, দিনাজপুরের হিলি, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থল বন্দরে প্রবেশ করছেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই। এতে করে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি বাংলাদেশে বস্ন্যাক ফাঙ্গাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের (ডিজিএইচএস) রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি কিছু সুপারিশ তৈরি করছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের স্বাস্থ্যসেবা উপদেষ্টা কমিটিও এই রোগ প্রতিরোধে কিছু বিধিবিধান তৈরি করছে। বস্ন্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় এগুলো খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসের কোনো অস্বাভাবিক সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। এ বিষয়ে বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লাভলি বাড়ৈ বলেন, আমাদের ল্যাবে দু’জনের শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি এবং বস্নাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। তবে বস্ন্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে অবস্থা গুরুতর হতে পারে। তাই, তাদের সতর্কভাবে চিকিৎসা দিতে হয়। দিলি্লর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের পরিচালক ডা. রনদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বোঝাতে কালো, সাদা, হলুদ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে এটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
ফাঙ্গাসটি একেক অঙ্গে একেক রকম রঙয়ের হয়ে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু এটি আসলে একই জাতের ফাঙ্গাস। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের এই ফাঙ্গাসের দ্বারা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। তিনি আরো জানান, সাধারণত তিন ধরণের ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখতে পাই আমরা- মিউকরমাইকোসিস, ক্যানডিডা অথবা অ্যাসপারগিলাস ফাঙ্গাস সংক্রমণ। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মিউকোরমাইকোসিস। এটি পরিবেশেই অবস্থান করে এবং এটি সংক্রামক নয়। যেসব রোগীর কোভিড চিকিৎসার সময় স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়েছে বা যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই ফাঙ্গাসের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।