ট্রাম্পের নিন্দিত যুগের অবসান শপথ নিলেন জো বাইডেন

 

ট্রাম্পের নিন্দিত যুগের অবসান  শপথ নিলেন জো বাইডেন

Kbdnews  ডেস্ক:  নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে দেশটির স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় (বাংলাদেশ সময় গতকাল বুধবার রাত ১০টা) ক্যাপিটল হিলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ১২৭ বছরের পুরনো বাইবেলে হাত রেখে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। জো বাইডেনের পর ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে কমলা হ্যারিস শপথ নেন। হোয়াইট হাউজ থেকে শপথ অনুষ্ঠান বিভিন্ন গণমাধ্যম সরাসরি সমপ্রচার করেছে। শপথ অনুষ্ঠানে সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ হামলা এড়াতে ওয়াশিংটনে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে টাম্পের বিশ্বনিন্দিত ফ্যাসিবাদী যুগের অবসান ঘটল। এখন দেখার বিষয় বাইডেন কী পারবেন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো ঐতিহ্য-ইমেজ ফিরিয়ে আনতে।

জানা গেছে, ঘটনাবহুল ও নাটকীয়তায় ভরা নির্বাচনের আড়াই মাস পর গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেন। শপথ পাঠের সময় নিজ পরিবারের ১২৭ বছরের পুরনো বাইবেলে হাত রাখেন বাইডেন। করোনাভাইরাস ও নিরাপত্তার কারণে এবার সাধারণ মানুষ অনুষ্ঠানে নেই। যা মার্কিনীরা তাদের ইতিহাসে কখনো দেখেনি। প্রতিবার লাখ লাখ মানুষ অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করতে ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হন। আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনুষ্ঠান দেখতে আসে মানুষ। কিন্তু এবার সেই চিরচেনা দৃশ্যের দেখা মেলেনি শপথ অনুষ্ঠানে।
ট্রাম্পের নিন্দিত যুগের অবসান  শপথ নিলেন জো বাইডেন
আরো জানা গেছে, ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার সময় একহাত বাইবেলে রাখেন বাইডেন। এজন্য তিনি পরিবারের ১২৭ বছরের পুরনো বাইবেলটি ব্যবহার করেন। পাঁচ ইঞ্চি মোটা বাইবেলটি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বাবা ডক্টর জিল বাইডেন ১৮৯৩ সাল থেকে ব্যবহার শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন শপথ নেয়ার সময় এক হাত বাইবেলে রেখেছিলেন। এরপর থেকে প্রায় সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই শপথ নেয়ার সময় বাইবেলে হাত রেখেছেন। এ বিষয়ে কোনো গাটবাঁধা নিয়ম না থাকলেও রীতি হিসেবে মেনে নিয়েছেন সবাই। সেই রীতি অনুযায়ী পরিবারের বাইবেলকেই বেছে নিলেন বাইডেন।

এ বিষয়ে জো বাইডেন বলেছেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব শপথে এই বাইবেলের ওপর হাত ছিল আমার। ১৯৭৩ সালে বাইডেন প্রথম মার্কিন সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন। সেবার শপথ গ্রহণের সময় পরিবারের পুরনো এই বাইবেলের ওপরই হাত রেখেছিলেন তিনি। এরপর থেকে তিনি যতবার সিনেটর হিসেবে শপথ নিয়েছেন ততবারই তিনি এই বাইবেলে হাত রেখে কার্যক্রম করেছেন। বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার সময়ও একই কাজ করেছেন তিনি। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার সময় এই বাইবেলটি দেখেছে বিশ্ববাসী।

সূত্র জানায়, বিচিত্র সব ঘটনার পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে জো বাইডেনের। বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেন।

ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার আশঙ্কায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিল যেন একটি অবরুদ্ধ দুর্গ। পুরো রাজধানীজুড়ে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এছাড়াও ৫০ অঙ্গরাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় সতর্কতা জারি রয়েছে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মোতায়েন করা হয়েছে ২৫ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য। ওয়াশিংটন ডিসির বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় দেয়া হয়েছে ৭ ফুট উঁচু বেষ্টনী। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের সশস্ত্র হামলার আশঙ্কায় এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেই সাথে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে মার্কিনিদের সরাসরি যোগদানে নিরুৎসাহিত করা হয়। অনুষ্ঠানে বরাবরের মতো লাখো মানুষের উপস্থিতি ছিল না। মাত্র ২০ হাজার মার্কিনী উপস্থিত ছিল জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে।

জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে ক্যাপিটল হিলের মুক্ত চত্বরে উপস্থিত ছিলেন বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে বারাক ওবামা, জর্জ বুশ ও বিল ক্লিনটন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, প্রথা ভেঙে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সব মিলিয়ে এক প্রতিকূল পরিবেশে ৪৬তম প্রেসিডেন্টকে বরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্পের নিন্দিত যুগের অবসান  শপথ নিলেন জো বাইডেন
অপর একটি সূত্র জানায়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। এটাই এখন বাইডেনের জীবনে সবচেয়ে বড় সত্যি। যতটা কষ্ট করে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তার চেয়ে আরো কয়েকগুণ দুর্ভোগ তার জন্য সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে। নির্বাচনের পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বাইডেনকে। নির্বাচনের পর থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইডেনের জয়কে অস্বীকার করে আসছিল। তার প্রশাসন বাইডেনকে চরম অসহযোগিতা করেছে। আর সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি পার্লামেন্ট ভবনে সহিংসতা ঘটনা এটা স্পষ্ট করেছে যে, বাইডেনের সামনের দিনগুলো মোটেও সহজ নয়। করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য বাইডেনকে বেশ ভুগতে হবে। তার পরবর্তী দিনগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গেই পার করতে হবে। ১৯৮৭ এবং ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০২০ সালে আবারো তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। এবার আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জয় এসে তার কাছে ধরা দিয়েছে।

জো বাইডেন ১৯৬৮ সালে একটি ল ফার্মে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি হিসেবে নিযুক্ত হন জো বাইডেন। ১৯৭০ সালে কান্ট্রি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর নিজস্ব ল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর স্যালেব বগসের বিপক্ষে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী মনোনীত হন তিনি। এরপর মার্কিন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লেখেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পঞ্চম সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর হিসাবে নির্বাচিত হন ২৯ বছরের বাইডেন। এরপর ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০২ এবং ২০০৮ সালে সিনেটর হিসেবে টানা নির্বাচিত হন জো বাইডেন। সিনেটর হিসেবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ইরাক নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারিতে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে পরের বছর এই লড়াইয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন তিনি। ২০০৭ সালের কথা। আবারো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারিতে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন। ওই সময় বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে ব্যর্থ হন।

হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতে পারেননি তিনি। পরে ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে টেলিফোন পান তিনি। বাইডেনকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন ওবামা। ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি বাইডেন মার্কিন ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একই পদে ছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর জো বাইডেনের জন্ম। বাবা জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র, মা ক্যাথরিন ইউজেনিয়া ফিনেগান। মা আইরিশ বংশোদ্ভূত।

উত্তরপূর্ব পেনসিলভেনিয়ার স্ক্র্যানটনে বেড়ে ওঠেন তিনি। বাবা বাইডেন সিনিয়র ছিলেন ফারনেস ক্লিনার। তবে জীবনের বড় একটি সময় কেটে গেছে গাড়ির সেলসম্যান হিসেবে। ছোটবেলা থেকে প্রবল দারিদ্রের মাঝে বড় হয়েছেন মার্কিন এই রাজনীতিক। কিন্তু সব সময়ই তার মধ্যে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ কাজ করত। দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি আমেরিকানদের জন্য ভালো কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

তবে ট্রাম্প গত চার বছরে সবচেয়ে বেশি বিরোধে জড়িয়েছে চীনের সঙ্গে। দেশটির সঙ্গে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছিলেন ট্রাম্প। চার বছর ধরে চীনের সঙ্গে বিরোধের জন্ম দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন শুধু চীনের সঙ্গেই বিচ্ছেদ ঘটায়নি, বিশ্বায়নের সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।
ট্রাম্পের নিন্দিত যুগের অবসান  শপথ নিলেন জো বাইডেন
যে কারণে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড়িয়েছিল ‘একলা চলো’। বাইডেন যে মর্যাদা ও খ্যাতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন, তার মানে হচ্ছে, আমেরিকাকে চীনের সঙ্গে গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। বৈশ্বিক নেতৃত্ব নেয়ার লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসার ইচ্ছা জো বাইডেনের নেই। তিনি চীনের সাথে সম্পর্কের সুর বদলাতে আগ্রহী। ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তিতে ফেরাও তার অন্যতম লক্ষ্য। ইয়েমেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বন্ধে প্রয়োজনে সৌদি আরবের ওপর চাপ তৈরির জন্য ডেমোক্র্যাটদের বামপন্থি অংশের ভেতর থেকে বড় ধরনের চাপ রয়েছে বাইডেনের ওপর। কিউবার সাথে বৈরিতা দূর করার ব্যক্তিগত ইচ্ছাও রয়েছে জো বাইডেনের।

ট্রাম্প বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো বাইডেনকে বেশ ‘অসুবিধায়’ ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যে অসুবিধার কারণে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আমেরিকার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক সময় লেগে যেতে পারে বলে ধারণা। তবুও নিউইয়র্ক টাইমসের সেই সম্পাদকীয় প্যানেলের নিবন্ধ ধরেই বলতে হয়, ‘ধীরে ধীরে মার্কিনিদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেবেন বাইডেন।’ এখানেই সবচেয়ে বড় শঙ্কা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post