হাজী সেলিমের পেশীশক্তি বলে জমি দখল বহুজন বসতভিটা হারিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন

 

hagesalim

স্টাফ রিপোর্টার :  ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী সেলিমের ছেলে ইরফানের কারাদণ্ড হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন বহু ভুক্তভোগী। হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জমি দখলের অভিযোগ থাকলেও, এতদিন মুখ বুজে ছিলেন ভুক্তভোগীরা। অন্তত দেড় শতাধিক বাড়ি, প্লট ও মার্কেট জোরপূর্বক দখল করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। এছাড়াও ৭০ সদস্যের শক্তিশালী অস্ত্রধারী গ্যাং গড়ে তুলেন হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া ছিলেন ইরফান সেলিম।

জানা গেছে, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করেছেন হাজী সেলিম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে জমিটির ভোগদখলকৃত দাবিদার রাষ্ট্রয়ত্ত্ব্ব প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। পুরান ঢাকায় যেখানে এক ইঞ্চি জমি কেউ ছাড় দিতে চায় না, সেখানে ২০১০ সাল থেকে এই জমিটি প্রভাব খাটিয়ে দখলের অভিযোগ করেছিলো অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকের দোতলা স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দখল করা হয়েছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার পুলিশ, র‌্যাবের কাছে যাওয়ার পরও প্রতিকার মেলেনি। উল্টো প্রাণনাশসহ নানা ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের পক্ষ থেকে।
হাজী সেলিমের
একইভাবে পুরান ঢাকায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক ভবন জাহাজ বাড়ি দখল করে ভেঙে ফেলারও অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের নামে। গত বছর ঈদের রাতে ভবনটি বুল ডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। একজন নির্মাণ শ্রমিক বলেন, কয় তলা করবেন জানিনা, আন্ডারগ্রাউন্ডে পাইলিং চলছে যেন আরেকজনের ক্ষতি না হয়। এই জমি হাজী সেলিমের। যেখানেই খাস জমি সেখানেই হাজী সেলিমের থাবা। এ নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভও জানান স্থানীয় বাসিন্দাদের।

হোল্ডিং নম্বর ৫৬/৩/বি রাজ নারায়ণ ধর রোড। লালবাগের তিনতলা এ বাড়িটির মালিক মো. আজিম উদ্দিন ও তার আট ভাইবোন। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে হাজী সেলিমের ছোট্ট একটু জমি। ওই জমিতে ভবন করতে গিয়ে তার নজর পড়ে পাশের তিনতলা ভবনের ওপর। জমিটি কব্জা করতে নানা কৌশল এঁটে আর হুমকি-ধমকি দিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। এরই মধ্যে আজিম উদ্দিন যখন পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান, তখন সুযোগ বুঝে তাদের তিনতলা ভবনটি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন হাজী সেলিম, ভবনের জমি নিয়ে নেন নিজ দখলে। এর পর গত ৯ বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও জমিটি ফেরত পাননি আজিম উদ্দিন।
হাজী সেলিমের
স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৯৯৬ সালের পর লালবাগ ও চকবাজার এলাকার মধ্যে যেখানেই খালি জমি পেয়েছেন, সেখানেই হাত পড়েছে হাজী সেলিমের। এ নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পায়নি কেউ। পুরান ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার হাজী সেলিমের নির্যাতনে পিষ্ট, যারা তাদের সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে ওই এলাকাই ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। লালবাগ থানা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের এক একর জমি দখল করার অভিযোগও রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। সংস্থাটির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্পের অনুকূলে সরকার ওই জমি স্কুলকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করে অনুমোদন দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাজী সেলিম ওই জায়গা জবরদখল করেছেন। আদালতও আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু এর পরও হাজী সেলিমের কারণে আমরা দখলে যেতে পারিনি।

চকবাজারের ছোটকাটারায় বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে হাজী সেলিমের চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ। তবে বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন কোল্ড স্টোরেজের জায়গাটি একাধিক মালিকের কাছ থেকে জোর করে দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। ওই জমির মধ্যে সাত কাঠা জমির মালিক বলে দাবি করেন পুরান ঢাকার হাজী বদিউজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, জমির সকল প্রকার কাগজপত্র আমাদের নামে। এর পরও জায়গাটি জবরদস্তি দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। বিভিন্ন সময় আমরা জমিটি উদ্ধারের চেষ্টা করলেও হুমকি-ধমকির কারণে শেষ পর্যন্ত পারিনি। হাজী বদিউজ্জামান সরকারের কাছে অনুরোধ রেখেছেন, জমিটি যেন সঠিক মালিকদের বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, ভয়ে কেউই মুখ খুলছে না। চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ ও এর আশপাশের সব জায়গায়ই জোর করে দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। আমরা যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু হাজী সেলিম আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকেই অত্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। অব্যবহৃত জমি পেলেই দখলে নিচ্ছেন।
হাজী সেলিমের
পুরান ঢাকার চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ। ২০০১ সালের দিকে এই কোল্ড স্টোরেজ তৈরির সময়ে স্থানীয় আবদুর রহমানের দুই কাঠা জমি দখলে নেন হাজী সেলিম। এরপর বিভিন্ন সময়ে ওই জমি উদ্ধারে চেষ্টা করেছিলেন আবদুর রহমান। কিন্তু সফল হননি। এ বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে হাজী সাহেবের (হাজী সেলিম) সঙ্গে বসেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। জমিটি উদ্ধার করতে পারিনি।

স্থানীয় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, পুরান ঢাকার জামিল স্টোরের ৫ কাঠা জমি, মদিনা আশিক টাওয়ার ও জাপান ইলেক্ট্রনিক্সের জায়গা দখল করেছেন হাজী সেলিম।

চকবাজার এলাকার নলগোলা সর্দার হার্ডওয়্যার মার্কেটটি ভাওয়াল এস্টেটের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এটিও দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। যদিও এ নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। একই দশা চকবাজারের বশির মার্কেটের। মার্কেটটি গত বছর কোরবানির ঈদের রাতে হঠাৎ করেই ভেঙে ফেলেন হাজী সেলিম এবং নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। পুরান ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, মনসুর খান প্লাজা ও হারিকেন মার্কেটও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। যদিও ভুক্তভোগীরা এ নিয়ে মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন। কেবল সাধারণ মানুষের জমি, ওয়াকফ সম্পত্তি আর বধিরদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাই নয়, ঐতিহ্যবাহী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বত হলও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। সেখানে গড়ে তুলেছেন তার স্ত্রীর নামে একটি মার্কেট, গুলশান আরা সিটি।

অপরদিকে, সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের জীবনের বড় একটি অংশই কেটেছে দেশের বাইরে। পড়াশোনার সুবাদে কানাডায় ছিলেন বহু বছর। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ছিল নিয়মিত যাতায়াত। সেখান থেকেই তাকে পেয়ে বসে ভয়ংকর সব নেশা। এই নেশা কেবল মাদকের নয়, বরং সিনেমার ভিলেনের মতো চলার নেশা। এমন চিন্তা থেকেই তিনি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নিজস্ব নেটওয়ার্কিং সিস্টেম গড়ে তোলেন। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করেন। দখলদারি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এবং রাস্তায় বের হয়ে চলাচলে ছিল তার নিজস্ব সিগন্যাল ব্যবস্থা। তার কথা না শুনলে শায়েস্তা করতে ছিল ‘টর্চার সেল’। বিভিন্ন সময়ে বাইরে বের হলে সঙ্গে রাখতেন ‘কমান্ডো নাইফ’, পিস্তলসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও মদের বোতল। আর এসবকে ইরফান বলছেন শখ। চকবাজারের রাজসিক প্রাসাদ চাঁন সরদার দাদা বাড়ি থেকে র‌্যাবের হাতে আটকের পর ইরফান সেলিম সম্পর্কে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে।

কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের ৭০ জনের বেশি সদস্যের এক শক্তিশালী গ্যাং রয়েছে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান যোগাযোগ রক্ষা করতেন ইরফান। নিজের চলাফেরার জন্য সব সময় পাশে রাখতেন ১২ জন দেহরক্ষী। অধিকাংশ দেহরক্ষীরই অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। ব্যবহারের চেয়ে ভয়ভীতি দেখানোর কাজে ব্যবহার করা হত এসব অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলো অবৈধ পথে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। গত মঙ্গলবার তার দেহরক্ষী জাহিদুলের কাছ থেকে এমনই একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব সূত্র বলছে, দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়মিত মদ পান করেন ইরফান। ঘটনার দিন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খানকে যখন মারধর করা হয় তখনো তিনি মাদক সেবন করেছিলেন। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থাতেই মারধর করেন তিনি। ঘটনার পর বাসায় ফিরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন ইরফান। এই মারধরের পরিণাম ভাল হবে না ভেবে আবার দাদা বাড়ির চারতলায় নিজের বারে ঢুকে সারারাত মদ পান করেন। অভিযান শুরু হলে র‌্যাবকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের মদ পানের কথাও স্বীকার করেন। অভিযান চলাকালীন সময়েই তার ডোপ টেস্ট করে র‌্যাব। সেটার রেজাল্টও পজিটিভ আসে।
হাজী সেলিমের
সূত্র আরো জানায়, ইরফানের নিজের বাসা ও অফিসকে তৈরি করেছিলেন অনেকটা দুর্গের মতো করে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করেন এমন ওয়াকিটকি, হাতকড়া, ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস পাওয়া যায়। মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের জন্য সেখানে গড়েছিলেন টর্চার সেল। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত হওয়া এই কাউন্সিলর সম্পর্কে সরেজমিনে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর এবং বাড়ি তল্লাশির পর র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাদ- দেয়ার পর ইরফানকে গত মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ আদেশ জারি করে।

 

 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post