পাহাড়ে ফের অস্ত্রের মহড়া

বান্দরবানেpahar

দু’গ্রুপের গোলাগুলিতে ৬ জন নিহত

স্টাফরিপোটার :   ৩ পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে এখনো কমেনি সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লাগামহীন খুন, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে নিরাপত্তাহীন পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ মানুষ। সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলেও অবৈধ অস্ত্রধারীদের কারণে তা অগ্রসর হতে পারছে না। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বান্দরবান সদর উপজেলার বাগমারায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও আরও ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহতরা হলেন-জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের বান্দরবান সমন্বয়ক রতন তঞ্চঙ্গ্যা, সদস্য বিমল কান্তি চাকমা, ডেবিট মারমা, প্রগতি চাকমা, দিপেন ত্রিপুরা ও জয় ত্রিপুরা। নিহতরা সবাই জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সদস্য। তবে কারা এ হামলা চালিয়েছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের হামলাই প্রমাণ করে পাহাড়ে ফের শুরু হয়েছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি।

বান্দরবানে
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের বান্দরবান সমন্বয়ক রতন তঞ্চঙ্গ্যা বাসায় নাশতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কয়েকজন। এ সময় সশস্ত্র একদল সন্ত্রাসী তাদের ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি গুলি করে।

ঘটনাস্থলে ৬ জনের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হন বিদ্যুৎ ত্রিপুরা ও নিরু চাকমা নামে দুই কর্মী। বান্দরবান জেলার ৬ নং নোয়াপতং ইউনিয়নের মেম্বার মিচি মার্মা বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে ৬ জনের লাশ দেখেছি। গুলিবিদ্ধ ২ জনকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদিকে ঘটনার পর জেলা সদর থেকে সেনা সদস্য ও পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা নিহত ও আহতদের জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ঘটনারপর পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনার পর জেলা শহরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে বান্দরবানে নতুন করে ঘাঁটি গড়ে তোলা জনসংহতি সমিতি সংস্কার (এমএন লারমা) এবং স্থানীয় সশস্ত্র সংগঠন মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) আধিপাত্য বিস্তারের বিরোধ চলে আসছে। পাল্টাপাল্টি হামলায় গত এক বছরে বান্দরবানে আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রায় ২০ জন নিহত হয়েছে। বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জেরিন আক্তার বলেন, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে জেলার সদর উপজেলার বাগমারা এলাকায় দুই দুল সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় জেএসএস এমএ লারমা গ্রুপের এই ৬ সদস্য নিহত হয়েছেন। এছাড়াও ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কারা বিষয়টি তদন্ত না করে বলা ঠিক হবে না। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে গুলির খোসাসহ সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া গেছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
বান্দরবানে
সূত্র জানায়, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা দিন দিন তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। মজুদ বাড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদের। সীমান্ত হয়ে ঢুকছে এসব অবৈধ অস্ত্র। শান্তি চুক্তিবিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র উইংগুলোতো আছেই, এর সাথে সন্তু লারমার জেএসএস এবং তার বড় ভাই (নিহত) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমাপন্থী ্তুজেএসএস সংস্কার গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুরো পাহাড়ি অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে। বাঙালিই শুধু নয়, তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না পাহাড়ি সাধারণ উপজাতিরাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। এসব সংগঠনের প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীদের ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খুলতে ভয় পান।
অস্ত্রের মহড়া
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই এলাকায় চাকরি করেন, তারা শুধু দিন গুণেন ঐ এলাকা থেকে কবে অন্যত্র বদলি হবেন। কোনো কোনো থানার ওসিও ভয়ে ঐ সন্ত্রাসীদের তৎপরতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও সেখানে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়।

অপর একটি সূত্র জানায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে আলোচনা শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্রসর্ম্পণ করে। আত্মসর্মপণের দিনই পাহাড়িদের একটি অংশ চুক্তির বিরোধিতা করে অনুষ্ঠানস্থলে চুক্তিবিরোধী প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে। এরপর চুক্তির বিরোধিতা করে প্রসীত খিসার নেতৃত্বে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ। চুক্তির কয়েক বছর যেতে না যেতেই চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একইভাবে ইউপিডিএফও দুইভাবে বিভক্ত হয়। এরপর থেকে ৪ ভাগের পাহাড়ি সংগঠনের মধ্যে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। অপরদিকে, গহীন অরণ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল দুর্বলতার সুযোগে পাহাড়ে ঢুকছে অহরহ অস্ত্রের চালান। বাংলাদেশ-মায়ানমার ও বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকা রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিজোরাম সীমান্ত ঘেঁষেই রয়েছে একটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী দলের প্রধান কার্যালয়। অনায়াসেই তারা বাংলাদেশ-ভারতে যাতায়াত করছে।

অন্যদিকে মায়ানমার থেকেও অস্ত্র আসছে। সন্ত্রাসীরা পার্বত্য অঞ্চলের ভাবনা কেন্দ্রের ভান্তে পরিচয় দিয়ে ছোট অস্ত্র আনছে। গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জেনেছে, তারা বাংলাদেশি নয়। বাংলাদেশের পরিচয়পত্র তাদের হাতে নেই। এসব অস্ত্র পাহাড়ের ৩টি সন্ত্রাসী সংগঠন, জঙ্গি ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের হাতে যাচ্ছে।

গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি পাহাড়ি এলাকা দুর্গম হওয়ায় ঐ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এখনো অরক্ষিত। বিভিন্ন নামে মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে সেখানে। তাদের নানাভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল। এসব সংগঠন ছাড়া দেশীয় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপও পাহাড়ে অশান্তির আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের ৩৬৯ কিলোমিটার অরক্ষিত পাহাড়ি এলাকা ঐ অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বান্দরবানে

Post a Comment

Previous Post Next Post