খুলনা থেকে বি এম রাকিব হাসান : পাট সেক্টরে চলছে ধর্মঘট। মিছিলে মিছিলে গোটা শিল্পাঞ্চল ছিল প্রকম্পিত। অভুক্ত শ্রমিকদের আহাজারিতে ক্রমেই এ অঞ্চলের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। আর বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের কদর বাড়লেও দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন হচ্ছে না। অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়ছে সরকারি পাটকলগুলো। ১১ দফা দাবিতে রাজপথে দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন পাটকল শ্রমিকরা। দৃশ্যত তা নিয়ে কারো যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
এদিকে বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘট বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত চলবে। সকাল থেকে পাটকলের উৎপাদন বন্ধ রেখে রাজপথে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এ সময় দফায় দফায় মিছিল ও মিল গেটের সামনের সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালানো হয়। খুলনার ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ন, আলিম এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা এ কর্মসূচি পালন করে। পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, বকেয়া মজুরি-বেতন পরিশোধ, মজুরি কমিশন কার্যকর ও প্রতি সপ্তাহের মজুরি প্রতি সপ্তাহে দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে গত ১৭ নভেম্বর ৬ দিনের কর্মসূচির ডাক দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. মুরাদ হোসেন জানান, পাটকল শ্রমিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মজুরি ও বেতন না পেয়ে সংসার চালাতে পারছে না তারা। খুলনা অঞ্চলের নয়টি পাটকলের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের ৯ থেকে ১২ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। এছাড়া সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুই থেকে চার মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বার বার আশ্বাস দেওয়ার পরও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) পাটকল শ্রমিকদের মজুরি কমিশন কার্যকর করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
এদিকে ধর্মঘট চলাকালে পৃথক পৃথকভাবে মিল গেটে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল হামিদ সরদার, যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. মুরাদ হোসেন, প্লাটিনাম মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা সারমিন, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, খালিশপুর জুট মিল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম শেখসহ সিবিএ-নন সিবিএ নেতারা। সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে শ্রমিকদের ১১ দফা বাস্তবায়নের জন্য বিজেএমসি কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানান। অপরদিকে শ্রমিক নেতারা আশঙ্কা করছেন, রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো আবারও হাতিয়ে নিতে পাঁয়তারা করছে একটি কুচক্রীমহল। তাই শ্রমিকরা ১১ দফা দাবিতে রাজপথে নামলেও সরকার বা বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কেউ এগিয়ে আসেনি তাদের সমস্যা সমাধানে। শ্রমিক নেতারা বলেন, লোকসানের অজুহাতে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া না হলেও কর্মকর্তাদের বেতন বকেয়া থাকে না।
প্রবীণ শ্রমিক নেতা বেল্লাল হোসেন বলেন, অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সম্ভাবনাময় এই খাত মুখ থুবড়ে পড়ছে। এটা শুরু হয়েছে দেশের স্বাধীনতার পর থেকে। সরকারের সুবিধাভোগী একটি মহল চক্রান্ত করে রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। অসাধু কর্মকর্তারা পাটকলগুলো লোকসান দেখিয়ে অল্প দামে কারখানা ও এর জমি বিক্রির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
তিনি আরো বলেন, সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পাটক্রয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ফলে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক রাজপথে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তিনি আরো বলেন, সরকারের সাড়া নেই, মিলে পাট নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। অন্যদিকে বিজেএমসি ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বেতন বকেয়া থাকে না। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বেতন বকেয়া থাকে। বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্রিসেন্ট, প্লটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ন, আলিম এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলে স্থায়ী ও বদলি শ্রমিক রয়েছে মোট ২৯ হাজার ৬২৯ জন। তাদের ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। ১ হাজার ২৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বকেয়া রয়েছে ২ থেকে ৪ মাস। সব মিলিয়ে তাদের পাওনা রয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এ অঞ্চলের ৯টি পাটকলে বর্তমানে ৩০ হাজার ৪৬২ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রির অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২৮০ কোটি টাকা। উৎপাদিত পণ্য সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় মিলগুলো আর্থিক সংকটে পড়েছে।