টিআইবি'র প্রতিবেদন প্রতিবেদন

টিআইবি

স্টাফ রিপোর্টার : দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্যতম বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দেশের সেবাখাত নিয়ে সংস্থাটির এক জরিপের ফলাফল তুলে ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ দাবি করা হয়েছে।

জরিপের তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি বিরোধীটি এই সংস্থাটি বলেছে, ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো ৩টি-আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই ৩ খাতে ঘুষও নেয়া হয়েছে সবচেয়ে

বেশি। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বিআরটিএ। এরপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং পাসপোর্ট সেবাখাত। দুর্নীতির শিকার এই ৩টি খাতের পরেই রয়েছে, বিচারিকসেবা, ভূমিসেবা, শিক্ষাসেবা এবং স্বাস্থ্যসেবা। টিআইবি বলছে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন খাত থেকে সেবা গ্রহণকারীরা গড়ে ৫ হাজার ৯শ’ ৩০ টাকা ঘুষ দিয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই জরিপ করেছে টিআইবি। জরিপে ১৫ হাজার ৫৮১টি খানা অংশ নেয়। এর আগে ২০১৫ সালেও একই জরিপ চালায় টিআইবি।

ধানমন্ডিতে টিআইবি’র কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা খাতে সেবা মেলে না।

জরিপে বলা হয়, জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬ দশমিক ৫ ভাগ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। পরিসংখ্যানগত তাৎপর্য নিরিখে এই হার ২০১৫ সালের খানা জরিপে প্রাপ্ত হার (৬৭ দশমিক ৮ ভাগ) এর সমান। ২০১৭ সালে ৪৯ দশমিক ৮ ভাগ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে যা ২০১৫ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ পয়েন্ট কম। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। খানা প্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৪ হাজার ৫শ’ ৩৮ টাকা থেকে ১ হাজার ৩শ’ ৯২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯শ’ ৩০ টাকা। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৮ হাজার ৮শ’ ২১ দশমিক ৮ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৮শ’ ৬৭ দশমিক ১ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে। ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬শ’ ৮৮ দশমিক ৯ কোটি টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩ দশমিক ৪ ভাগ এবং বাংলাদেশের জিডিপি’র ০ দশমিক ৫ ভাগ।

জরিপে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭২ দশমিক ৫ ভাগ), পাসপোর্ট (৬৭ দশমিক ৩ ভাগ), বিআরটিএ (৬৫ দশমিক ৪ ভাগ), বিচারিক সেবা (৬০ দশমিক ৫ ভাগ), ভূমি সেবা (৪৪ দশমিক ৯ ভাগ), শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) (৪২ দশমিক ৯ ভাগ) এবং স্বাস্থ্য (৪২ দশমিক ৫ ভাগ)। তবে শুধু ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ বিবেচনায় সেবা নিতে গিয়ে বিআরটিএ খাতে সর্বাধিক খানা (৬৩ দশমিক ১ ভাগ) ঘুষের শিকার হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট সেবায় ঘুষের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ৬০ দশমিক ৭ ভাগ ও ৫৯ দশমিক ৩ ভাগ খানা।

টিআইবি যে ১৫টি খাত নিয়ে এই গবেষণা চালায় তা হলো-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা এবং গ্যাস।

ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে ঘুষের হার কমলেও দায়িত্ব পালনে অনীহা, অসদাচরণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ প্রভৃতি অনিয়ম-দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আত্মসাৎজনিত দুর্নীতি কমেছে। পাশাপাশি হয়রানি বা জটিলতা এড়ানো, নির্ধারিত ফি জানা না থাকা এবং নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়া খানার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পক্ষান্তরে, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দেয়া খানার সংখ্যা হরাস পেয়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বিভিন্নখাতে সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, তদারকি বৃদ্ধি এবং স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে এবং কয়েকটি (৭টি) সুনির্দিষ্ট খাতে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার হরাস পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত ও দরিদ্র খানাসমূহ দুর্নীতির শিকার বেশি হচ্ছে। ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণকালে শহরাঞ্চলের ৬৫ ভাগ খানার বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের ৬৮ দশমিক ৪ ভাগ খানা দুর্নীতির শিকার হয়। আবার, শহরাঞ্চলের ৪৬ দশমিক ৬ ভাগ খানার বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের ৫৪ ভাগ খানা ঘুষের শিকার হয়। খানার প্রধান নিরক্ষর এমন ৭০ দশমিক ১ ভাগ খানা দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিপরীতে খানার প্রধান স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ্ব এমন ৫৮ দশমিক ৮ ভাগ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

সাংবাদিক সম্মেলনে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না-এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যাদের ওপর দায়িত্ব তারা দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনছেন না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেয়া সার্বিকভাবে আমাদের জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জাতি হেসেবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছি।

কিছু সূচক ও খাতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও সার্বিকভাবে দেশের দুর্নীতির চিত্র উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে কী করতে হবে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, পর্যবেক্ষক ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং দুর্নীতির বিচারের সময় যদি দুর্নীতিকারীর পরিচয়, অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা না থাকে তাহলে দুর্নীতির মাত্রা এত বেশি হতো না। জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরও বেশি প্রসারিত করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন যত বেশি স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে বলে ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিমত ব্যক্ত করেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। এসময় গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।

দেশের সেবা খাতসমূহে দুর্নীতি প্রতিরোধসহ সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবস্থান ও পরিচয় বিবেচনা না করে দুর্নীতি’র সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান আইনের আওতায় এনে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশসহ সেবাখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকর করার সুপারিশ করেছে বেসরকারি এই গবেষণা সংস্থাটি।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post