ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বাড়ল

কেবিডি রিপোর্ট:তারল্য সংকট দূর করা ও সুদের হার কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্তের কথা আগেই জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ইতোমধ্যে সেটির প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর ফলে এক লাখ কোটি টাকার বেশি সরকারি আমানত নিজেদের কাছে আনতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক মালিকদের চাপে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত ও একইসাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অন্য ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার- ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এক শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তে খেলাপি ঋণ ও আগ্রাসী ব্যাংকিং বাড়বে, উস্কে দেবে মূল্যস্ফীতিকেও। যার ফলে চাপের মুখে পড়বে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অব্যাহতভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে যে দুর্নীতি চলমান তাতে করে ব্যাংকিং খাত রাষ্ট্রের ভবিষ্যতকেও অনিণ্ডিত করে তুলেছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই এক সময় ব্যাপক অলস টাকা পড়ে থাকতো। এখন সরকারি ব্যাংকে কিছু অলস তারল্য থাকলেও বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় অলস তারল্য থাকাতো দূরের কথা

নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোয় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তা কমে মাত্র ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

সরকার বেসরকারি ব্যাংক রক্ষার নামে এখন সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যমান নিয়মে সরকারি তহবিলের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যায়। বর্তমানে তো বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি আমানতের এই ২৫ শতাংশ খুঁইয়েছে।

এবার তাহলে শুরু হবে ঘোষিত ৫০ শতাংশ আমানত খাওয়ার পালা? সংকটের উৎসে হাত না দিয়ে কেনই বা সরকারের এমন ঘোষণা? ব্যাংকিং সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতি, ঋণ অনিয়ম ও ব্যাংক লুটেরাদের কোনো বিচার না করে, উল্টো এখন দেয়া হবে আরো ৫০ শতাংশ আমানত। এই ৫০ শতাংশ আমানত আদৌ থাকবে কি? আর এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ফের তারল্য সংকট শুরু হবে না তো? তারল্য সংকটের মূল কারণ ছিল তো বেপরোয়া ঋণ। যার বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা না নেয়া ছাড়াই এমন ঘোষণা কতটা ফলপ্রসূ হবে?- এমন হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৮শ ৪৭ কোটি টাকা। এর ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিতে পারবে। অর্থাৎ ১ লাখ ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা পাবে বেসরকারি ব্যাংক। প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান তারল্য সংকটের সমাধান খুঁজতে সমপ্রতি ব্যাংক মালিক ও এমডিরা বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রীর সাথে। বৈঠকে বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত রাখার সীমা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়।

এদিকে দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ এখন প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা। গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় এসব অর্থের সরবরাহ ঠিক রাখতে বিধিবদ্ধ জমা-এসএলআর হিসেবে ১৩ শতাংশ এবং নগদ জমার হার-সিআরআর হিসেবে সাড়ে ৬ শতাংশ জমা রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সমপ্রতি ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ অর্থের সংকট-এ দোহাই দিয়ে গত রোববার রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সিআরআর এক-শতাংশ কমানোর।

তবে সরকারের নিজস্ব অর্থের ৫০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে এমন সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকাররা। তাদের মতে, ব্যাংকিং খাতের লুটেরাদের কোনো বিচার হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতি আর ঋণ অনিয়মের কারণে বাড়ছে খেলাপি, তার শাস্তিও হয়নি। তারল্য সংকটের মূল কারণ বেপরোয়া ঋণ। সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো দেয়া হচ্ছে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে সরকার তার তহবিলের অর্থ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সমান হারে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয় এমন দুর্বল ব্যাংকে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, সরকারি আমানত সংগ্রহে ইতোমধ্যেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা। যদিও এই দৌড়ঝাঁপ আগেও ছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন সার্কুলারের পর এর মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বেসরকারি ব্যাংকের প্রতিনিধিরা এখন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিচ্ছেন। সরকারি আমানত বের করে নিতে প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকরা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সরকারি আমানত পেতে অভিন্ন সুদহার এবং কে কত টাকা পাবে তা নির্ধারণ করে না দিলে সুবিধার অপব্যবহার হতে পারে। এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলে ফারমার্স ব্যাংকসহ লুটপাটকারী ব্যাংকগুলো আবার বেশি অর্থ পেয়ে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অর্থ দেয়ার আগে শর্ত দিতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংক এবং যে অর্থ দেবে দায়-দায়িত্ব তার এমন বিধান থাকতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের কোনো নিণ্ডয়তা নেই। আগের বিধান অনুযায়ী ২৫ শতাংশের সামান্য বেশি দেয়া যেতে পারে। তবে তা কিছুতেই ৫০ শতাংশ হতে পারে না।

সরকার শক্তিশালী নাকি দুর্বৃত্তরা শক্তিশালী প্রশ্ন রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এই দুর্বৃত্ত শ্রেণীরা ভালো ব্যবসায়ীকে সামনে আসতে দেয় না। যারা নিয়মনীতি না মেনে ব্যবসা করে তারা ক্ষতিই করে।’

তার মতে, নানাভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ডোবানো হয়েছে। একদিনে নয়, দীর্ঘদিন ধরে এর পেছনে পড়ে থেকে ব্যাংকগুলোকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর।

পিকেএসএফ’র চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব আর ঋণ দেয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাংক কর্মকর্তাদের নৈতিক প্রশিক্ষণের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকি জরুরি হয়ে পড়েছে।

এদিকে, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অর্থনীতি বিশ্লেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের অর্থনীতিতে দুর্বলতা রয়েছে। তবে এটা যে হুট করে ধসে যাবে তেমন নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী একটি সংকট হয়ে দাঁড়াবে। সিপিডির অর্থনীতি বিশ্লেষকের মতে, প্রায় ৬ থেকে ৭ বছর আগে থেকে দেখছি ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর বৈশ্বিক অর্থনীতির র‌্যাংকিং করি। সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির র‌্যাংকিংও করা হয়। তাতে দেখতে পাচ্ছি অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, তবে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা রয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post