মেহেরপুরের বিভিন্ন সীমান্তে রয়েছে মাদকের শক্ত ঘাঁটি ॥ আসছে অবাধে ধংস্ব হচ্ছে যুবক কিশোর

মেহেরপুরের বিভিন্ন সীমান্তে
॥স্টাফরিপোপটার ॥ চোরাচালানীচক্র ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে মেহেরপুরে ব্যাপকভাবে পাচার করে নিয়ে আসছে মাদকদ্রব্য। মাদকের অভিশাপে যুব সমাজ ধংস্ব হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে আটককৃত ৩০০ বোতল ফেনসিডিল ধ্বংস করা হয়েছে। গত বুধবার বিকেলে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্তরে মেহেরপুরের জৌষ্ঠ বিচারিক হাকিম (সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট) মো: ছানাউল্ল্যাহ উপসি’ত থেকে এসব ফেনসিডিল বিনষ্ঠ করেন। এসময় সেখানে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি শাহিন উদ্দিন, এসআই মেসবাহুর দারাইন, এস আই আমির হোসেন, এএসআই আসাদ উপসি’ত ছিলেন।
মামলার বিবরনে জানা যায়, গত ২২শে নভেম্বর ২০১৭ সালে ভোর ৬ টার দিকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মেসবাহুর দারাইনের নেতৃত্বে সদর উপজেলা নবীননগর খালপাড়ায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সীমান্তবর্তী ভারত হইতে চেরাচালানের মাধ্যমে আমদানি নিষিদ্ধ ভারতীয় তৈরী অবৈধ্য ফেনসিডিল মাদক ব্যবসায়ীরা খালপাড়া দিয়ে প্রবেশ করে। খালপাড়া ব্রীজের কাছাকাছি এসে পৌছালে পুলিশের উপসি’ত টের পেয়ে ৩০০ বোতল ফেনসিডিল ভরা প্লাষ্টিক বস্তা ব্রীজের পাশে ফেলে পালিয়ে যায় মাদক ব্যবসায়ীরা। পলাতক মাদক ব্যবসায়ীরা হলেন সদর উপজেলার নবীননগর গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে আরশেদ আলী (৪২), নূর ইসলামের ছেলে ছালাম (২৪), আমিন উদ্দিনের ছেলে জিযারুল ইসলাম (৩৫)। যার মামলা নং -১৮। এসময় এএসআই মাহাতাব উদ্দিন, ইব্রাহিম বিশ্বাস, কনস্টেবল লোকমান হোসেন, ইকবাল হোসেন, সাইফুল ইসলামসহ সঙ্গীয় ফোর্স উপসি’ত ছিলেন।
এ জেলার সীমান্তের এপার ওপারে রয়েছে মাদকের শক্ত ঘাটি । অন্তত: ১০ টি পয়েন্ট দিয়ে বানের পানির মতো মাদক পাচার হয়ে আসছে। এ সুবাদে গাংনীর বিভিন্ন স’ানে অন্তত দেড় শতাধিক মাদক আখড়া গড়ে উঠেছে। এ আখড়াগুলোতে বিক্রি হচ্ছে মদ, গাজা, ফেন্সিডিল ও স্পিরিট। তবে অধিকাংশ মাদক সেবীরা গাঁজা ও ফেন্সিডিলে আসক্ত। এসব আখড়া গুলো সিঁকিভাগ দিনের বেলায় খোলা থাকলেও অধিকাংশ আখড়া জমে উঠে সন্ধ্যার পর পরই। এসব আঁখড়া থেকে একশ্রেনীর দালালরা চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ করেছে মাদক ব্যবসায়িরা।
পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া বেশ ক’জন মাদক ব্যবসায়িদের দেয়া জবানবন্দীতে ফেন্সিডিল আখড়া ও পাচারের রুট সম্পর্কে পাওয়া গেছে বিচিত্র সব তথ্য। মেহেরপুর সদর উপজেলার শোলমারী, বুড়িপোতা, শালিকা এবং গাংনীর খাসমহল সীমান্তের ওপারে ভারতের ধাড়া ও তাজপুর এলাকার আয়নুল, ভাদু, মহন,ও শওকত ভারতের লাইনম্যান কমর উদ্দীনের মাধ্যমে চোরাচালানীরা বাংলাদেশে ফেন্সিডিল নিয়ে আসে। এর পর গাংনী উপজেলার রংমহল, তেঁতুলবাড়িয়া, কাজীপুর, সহড়াবাড়িয়া, খাসমহল, কাথুঁলী সীমান্তের বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে পৌছে যায় রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায়।
ফেন্সিডিল কারখানার অবস’ানঃ সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ ঘিরে গড়ে উঠেছে ৩০৭ টি ফেনসিডিল কারখানা। ২২ মালিকের এই সব কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল চোরাচালানির মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস’া গত বছর একটানা ৩ মাস মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে সীমান্তের ওপারের ফেনসিডিল কারখানার তালিকা তৈরি করে। অনুন্ধানকালে গোয়েন্দা সংস’ার সদস্যরা ক্রেতা সেজে দেখতে পান টাকা দিলে খুব সহজে মেলে ফেনসিডিল। তালিকা অনুযায়ে ভারতীয় নাগরিক এ আর আবদালির মালিকাধীন ৮টি ফেনসিডিল কারখানা। কারখানার অবস’ান কলকাতা থেকে ৪৭ কিঃ মিঃ দক্ষিণ টেংরা রোড এলাকায়। নিহাল আহমেদের মালিকানায় রয়েছে ১৭ টি কারখানা। এর অফিস কলকাতর কারবালা রোডে। কলকাতার ৪৪ পিয়াস লেনে অবসি’ত ১৪ টি কারখানার মালির এ.মোহাম্মদ। কলকাতার ৪৫ ডব্লিউ তাপাসিয়া রোডে অবসি’ত ৬টি কারখানা চালাচ্ছেন আরিফ মোহাম্মদ। কলকাতার ৩৫ ছাতাওয়ালা গলিতে লিন কিউ চিউয়ের ১৫টি কারখানা রয়েছে। কলকাতার ৪/৩ কাজী বস্তির দ্বিতীয় লেনের অফিস থেকে ৮টি কারখারার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আব্বাস আলী। তার কারখানা গুলো ৬২ ইউ তালজালা রোডে অবসি’ত। ৬৬/১ তালজালা রোডের অফিস থেকে ৭টি কারখানা চালাচ্ছেন সুকুমার মান্না। মকসুদ মোহাম্মদের রয়েছে ২৫টি কারখানা। কলকাতার ৫১ ইকবাল রোডে কারখানার অবস’ান গুলো হলেও অফিসের অবস’ান কালফালা রোডে। রামহোপাল মৃধা হাওড়ার ৪৩ডিবি রোড থেকে ২৭ টি কারখানা চালাচেছন। ভুবাশ মলিক চব্বিশপরগোনায় অফিস নিয়ে ৪৪টি কারখানা পরিচালনা করছে। ইদিল কানারির ৪টি কারখানা রয়েছে কলকাতার ৩৩/১ উত্তর টুপসিয়া রোড এলাকায়। ইজাজ মোহাম্মদ হাওড়ার ২ পি এম বস্তির দ্বিতীয় বাই লেনের অফিস থেকে ১৪টি কারখানা চালাচ্ছে। ৬০ টুপসিয়া কলকাতার অফিস থেকে ফাহাদ আবেদীর চালাচ্ছেন ১২টি কারখানা । কলকাতার মাহাতা বিল্ডিংয়ে ৫টি কারখানা রয়েছে ওসমান আলীর। অদিত্য মিত্তাল রাজারহাট অফিস থেকে ১১টি কারখানা চালাচ্ছেন। দিগন্ত বেগুলী উর্গেন্তি প্রেস কাশিপুর অফিস থেকে ১টি কারখানা পরিচালনা করছেন।২৫২-এ পিকনিক গার্ডেন রোডের অফিস থেকে তারাপদ আচেরিয়া ৩০টি কারখানা পরিচালনা করে থাকে।
ফেন্সিডিল পাচার হয়ে আসার পর দুর পার্ল্লার বাস ট্রাক ও রোগিদের অ্যাম্বুলেন্সে করে তা পৌছে যায় রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশে। তাছাড়াও স’ানীয় পর্যায়ে গড়ে উঠেছে মাদকের আঁখড়া। বিশেষ করে কাজিপুর , হাড়াভাঙ্গা, বামন্দি ও বাওটে রয়েছে অন্ততঃ ৩০ টি মাদকের আখড়া। এসকল আখড়া দিনের বেলায় সিঁকি ভাগ চললেও সন্ধ্যার পর থেকে জমে উঠে।তা চলে গভীর রাত পর্যন্ত, তাছাড়া বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ি শহরে ফেরি করে ফেন্সিডিল বিক্রি করে। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়েছে।
এলাকাবাসিরা জানালেন, বিভিন্ন মাদক ঘাঁটি ও আখড়া থেকে প্রশাসনের লোকজন পরিচয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলে। আবার বিনা পয়সায় সেবনের কাজটিও সেরে নেয়। যারা বখরা বা চাঁদা দিতে চায়না সোর্সের মাধ্যমে তাদের অবস’ান জেনে ধরিয়ে দেয়া হয়। আবার অনেক সময় যে পরিমান ফেন্সিডিল আটক করা হয় তার সিঁকি ভাগ উদ্ধার বা আটক দেখানো হয়। বাকিগুলো সোর্স ও দালালদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
যত্রতত্র মাদক ঘাটি ও অবাধে কেনা বেচার কারণে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যুব সমাজ ফেন্সিডিল আগ্রাসনের শিকার। এরা অনুকরণ, প্রেম বিরহ, পারিবারিক অশান্তি, কৌতুহলের বশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মধ্যবয়সি ও মহিলারাও মাদক পাচার এবং সেবনে জড়িয়ে পড়েছে। মাদকের টাকা যোগাতে বেশীর ভাগ লোকই চুরি ডাকাতি ও ছিনতাই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এরা এখন পরিবার প্রতিবেশী এমন কি সমাজেরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাদক ব্যবসা ও পাচারের বিষয়ে মেহেরপুরের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মাদক পাচারের বিষয়টি তিনি অবগত। তিনি দাবী করেন পুলিশ গত ২ বছরে ও চলতিমাস পযর্ন্ত অন্তত ৫ লাখ টাকার মাদক আটক করেছে।তিনি আরো জানান, যদি কেউ মাদকের আখড়া থেকে বা ব্যবসায়িদেরকে উৎকোচ নিয়ে মাদক পাচারে সহায়তা করে আর তা জানা গেলে আইনগত ব্যবস’া নেয়া হবে।

 

মেহেরপুরের বিভিন্ন সীমান্তে আগামী প্রজন্মকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা, মাদক পাচারকারি , মাদক বিক্রেতা সেবনকারি, একাজে প্রশ্রয়দানকারিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানিয়ে বৃহস্পতিবার জেলা তথ্য অফিসের আয়োজনে মেহেরপুর প্রেসক্লাবে প্রেস ব্রিফিং হয়েছে। এসকল সংক্রান্ত তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরবরাহ করার পাশাপাশি মাদকের কুফল সর্ম্পকে জনগনকে সচেতন করার কাজে অংশ নেওয়া প্রয়োজন। এর আলোকে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রনে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদকের অপব্যবহার বিরোধী তথ্য অভিযান সংক্রান্ত বিষয়ে এই প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন তথ্য অফিসার মোহাম্মদ আলী। প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শেখ ফরিদ আহম্মেদ। প্রেস ব্রিফিং এ বক্তব্য রাখেন মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আলামিন হোসেন, সাধারন সম্পাদক রফিক উল আলম, উপদেষ্টা কামরুজ্জামানখান, জেলা মাদকদ্রব্য আইনের কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, প্রমূখ। এসময় জেলার প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দরা উপস্থি’ত ছিলেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post