বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে চিংড়ি চাষীরা ফিরছে ধান চাষে

বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে চিংড়ি চাষীরা ফিরছে আবার ধান চাষে। জমির হারির (ভাড়া) মূল্য বেশি, লোনা পানি তুলতে বাধা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভাইরাস নামক রোগের কারণে চাষিরা ক্রমাগত লোকসান দিয়ে বাগদা চাষ থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মন্দাভাবের কারণে গলদা চিংড়ির দাম অর্ধেক নেমে আসায় রপ্তানির পরিমাণ কমেছে। যে কারণে আমনের বাম্পার ফলণের পর কৃষকের স্বপ্ন এখন ইরি বোরো চাষের দিকে। চিংড়ি চাষ ফেলে অনেকেই এবার ফের ঝুকছে বোরো চাষে।
বৃহত্তর খুলনায় এবার শীতের তীব্রতা এবং শৈত্যপ্রবাহের পরিমান অন্য বছরের তুলনায় কম। তাছাড়া এ অঞ্চলে তীব্র শীতের আগমনও ঘটে দেরিতে। তাছাড়া কুয়াশার আধিক্যতা কম। যে কারণে বোরো ধানের চারা উৎপাদন ভালো হচ্ছে। কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ এবার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তার চেয়ে শতকরা ১০/১২ ভাগ চারা বেশি উৎপাদন হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় চারা উৎপাদনে কৃষকের মুখে এখন নতুন স্বপ্নের এবং আনন্দের হাসি। খুলনা মেট্রোসহ জেলার ৯ উপজেলায় কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করছেন কৃষকসহ কৃষি কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, বৃহত্তর খুলনাঞ্চল মুলত চিংড়ি চাষ প্রবণ এলাকা। উপুকলীয় এই এলাকায় ব্যাপক হারে গত ২ যুগে চিংড়ি চাষ হয়। চিংড়ি চাষের কারণে এ অঞ্চলে গত দেড় যুগে একের পর এক ফিস প্রোসেসিং কালচার, মাছ কোম্পানী, ল্যান্ডিং সেন্টার গড়ে ওঠে। এ অঞ্চল থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার চিংড়ি মোংলা ও চট্রগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয় । কিন’ গত অর্ধযুগে চিংড়ি চাষে প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আইলা ও সিডর সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চিংড়ি চাষে ধ্বস নামে। শুরু হয় চিংড়ি ঘেরে চিংড়ি চাষের সাথে সমন্বিত ধান চাষ। ছোট ছোট চিংড়ি ঘেরে গত ৬/৭ বছর বোরো চাষে ব্যাপক সফলতা আসে। যে কারণে গত অর্ধযুগে চিংড়ি চাষীরা আবার ঝুকে পড়েছে এই ইরি বোরো চাষে।
জেলা মৎস্য অফিসের সূত্র জানায়, সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপে বিত্তবানরা আধানিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করছে। লোনা পানি তুলতে বাধা এবং রোগ বালাইয়ের কারণে ছোট ছোট ঘেরগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। ২০১৫-’১৬ অর্থ বছরে জেলার ৯ উপজেলায় ১৩ হাজার ৯৫৯ মেট্রিক টন গলদা এবং ১০ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন বাগদা উৎপাদন হয়। ২০১৬-’১৭ অর্থ বছরে গলদার উৎপাদন ১৩ হাজার ৬৬৭ মেট্রিক টন এবং বাগদার উৎপাদন ১২ হাজার ৪১১ মেট্রিক টন।
খুলনা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, পাশ্ববর্তী গোপালগঞ্জ জেলায় বোরো চাষে কৃষকের অর্জন অত্যন্ত ভালো। ঐ অঞ্চলের কৃষকরা তাদের ৯৫ শতাংশ জমিতে বোরো চাষ করে থাকে। তাদের দেখাদেখি গত একযুগে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের কৃষকরা চিংড়ি চাষের পাশাপাশি বোরো চাষে উদ্বুদ্ধ হয়। এ বছর চাষীদের আগ্রহ গত বছরের তুলনায় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাছাড়া আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। চলতি মৌসুমে খুলনা জেলায় বীজতলায় চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৮০৮ হেক্টর। অর্জিত হয়েছে ৩০৮৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ চারা বেশি উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে, চারার উৎপাদন ভালো এবং সারের সংকট না থাকায় মহানগরীসহ খুলনার ৯ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে খুলনা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪৮ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে মহানগরীতে ১৪.৫০ হেক্টর, রূপসায় ৫৬.৫০ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ৩৫.২৭ হেক্টর, দিঘলিয়ায় ৪০০০ হেক্টর, ফুলতলায় ৪৬০০ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ২০,০০০ হেক্টর, তেরখাদায় ৬.২০৯ হেক্টর, দাকোপে ১০০ হেক্টর, পাইকগাছায় ১৯১৪ হেক্টর এবং কয়রায় ১২০০ হেক্টর জমিতে। ২০১৩-১৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ৪৮২ হেক্টর। গতবারের চেয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করছেন কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র জানায়, গেল জুলাই মাসে ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৮ হাজার ডলার, আগস্ট মাসে ৪ কোটি ৩০ লাখ ৮১ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বর মাসে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার, অক্টোবর মাসে ৩ কোটি ১১ লাখ ডলার এবং নভেম্বর মাসে ২ কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার ডলার মূল্যের হিমায়িত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানিকারক দেশগুলো হচ্ছে নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, রাশিয়া, ডেনমার্ক, সাইপ্রাস, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইটালী, জার্মাণ, জাপান, পর্তুগাল, গ্রীস, সুইজারল্যান্ড, লিথুনিয়া, স্পেন ও পোল্যান্ড।
মৎস্য মান উন্নয়নের উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার জানান, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ইউকেতে গলদার চাহিদা কমেছে। গেল অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরের এই ক’ মাসে ১১শ’ মেট্রিক টন কম হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি গলদার দাম কমেছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার বরাতিয়া গ্রামের একজন কৃষক লিয়াকত সরদার জানান, তিনি গতবার ২ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। এবার শীত ও কুয়াশা অগ্রিম না আসায় চারা উৎপাদন ভালো হওয়ায় তিনি ৩ বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। বর্তমান সারের অভাব নেই। ফলে ভালো ফলনের আশাও করছেন তিনি।
বি এম রাকিব হাসান,
খুলনা ব্যুরো:
২৮-০১-১৮

Post a Comment

Previous Post Next Post