বহুল আলোচিত হল-মার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ও কমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির চারটি মামলায় পাঁচ প্রভাবশালী অভিযুক্ত ৬ হাজার ৫০৮ কোটির বেশি টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত কেউ একটি টাকাও জমা দেননি।
এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকা ব্যবসায়ী আহমেদ তাজউদ্দিনকে হাইকোর্ট প্রতি দুই মাস অন্তর দুই কোটি টাকা প্রদানের শর্তে আগাম জামিন দিয়েছিলেন। পরে তিনি নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পাওয়ার সময় আদালতকে এর আগে ঋণের কিস্তি হিসেবে সাড়ে তিন কোটি টাকা জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। দুদক মনে করে, এতেও টাকা দিয়ে জামিনের শর্ত পূরণ করা বোঝাবে না।
আবার জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শওকত চৌধুরী টাকা না দিলেও জামিনে মুক্ত। বাকি তিনজনের মধ্যে হল-মার্কের জেসমিন ইসলাম প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা করে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি এবং ডেসটিনির রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসেন ৩৫ লাখ গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা প্রদানে আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরা অবশ্য কারাগারে আছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ একটি টাকাও ফেরত দেননি।
জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কেবিডিনিউজকে বলেন, ‘যদিও আমরা টাকা উশুলের জন্য নয়, ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের কারণে বিচার প্রার্থনা করি, তবু আমরা কখনো টাকা ফেরতের শর্তের বিরোধিতা করিনি। কারণ টাকাটা জনগণের, এলেই ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হলো দুদক এভাবে একটি টাকাও ফেরত পায়নি।’
দেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে অন্যতম কেলেঙ্কারির নাম ডেসটিনি কেলেঙ্কারি। ব্যবসায়ের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণামূলক এমএলএম পদ্ধতিতে জনগণের কাছ থেকে ডেসটিনি চার হাজার কোটি টাকার মতো সংগ্রহ করে। তাঁদের কেউ কোনো টাকা ফেরত পাননি। আরেক আলোচিত ঘটনা হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে যে আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, তার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ব্যাংকটিকে প্রায় সমপরিমাণ টাকা মূলধন আকারে দিতে হয়েছে। আত্মসাৎ হওয়া টাকার সমান প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান দিতে হয়েছে বেসিক ব্যাংকের জন্যও। অথচ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সাংসদ শওকত চৌধুরী
দুদকের তদন্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে নীলফামারী থেকে নির্বাচিত জাপার সাংসদ শওকত চৌধুরী ভুয়া ঋণপত্র (এলসি) খুলে কমার্স ব্যাংকের প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত। হাইকোর্টের রায়ে তিনি বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহারের দায়েও অভিযুক্ত। ৫০ দিনের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা ফেরতের শর্তে তিনি জামিন পান। হাইকোর্টে তাঁর পক্ষে টাকা ফেরতের শর্ত পেশ করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজন।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁকে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। কিন্তু তিনি তা অমান্য করে গত ৪ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজের কাছ থেকে জামিন নেন। এতে ক্ষুব্ধ হাইকোর্ট তাঁকে দেওয়া জামিনের বৈধতার প্রশ্ন তুলে সুয়োমোটো রুল দেন। হাইকোর্ট মনে করেন, ওই বিচারক ‘বিবেচনাহীনভাবে’ তাঁর অধিকারের বাইরে শওকত চৌধুরীকে জামিন দিয়েছেন। শওকত চৌধুরী এ মামলার শুনানিতে হাইকোর্টে তাঁর আইনজীবী সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজনের মাধ্যমে টাকা ফেরতের প্রস্তাব দেন। আদালত ৩০ দিনের মধ্যে ৩০ কোটি টাকা দিতে বললে তাঁর আইনজীবী ৫০ দিনের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা দেওয়ার শর্ত মেনে নেন। গত ২২ অক্টোবর হাইকোর্ট তাঁকে ওই শর্ত সাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা হিসেবে তিনি একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক জমা দিতে পারেন, তাহলে অন্যরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। টাকা না দিলে তাঁর জামিন তাৎক্ষণিক বাতিল হবে।’
কমার্স ব্যাংকের আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, একটি টাকাও ফেরত না দিয়ে শওকত চৌধুরী ওই আদেশ স্থগিত করাতে এরপর আপিল বিভাগে যান। দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ প্রথম আদেশে চলতি বছরের ১২ নভেম্বর ও পরে আগামী ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করেন। আপিল বিভাগে তাঁর আইনজীবী সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপস।
এর ফলে এখন কোনো অর্থ না দিয়েই মুক্ত আছেন সাংসদ শওকত চৌধুরী। গত রাতে শওকত চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বা তাঁর আইনজীবী হাইকোর্টে ওই টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেননি। শওকত চৌধুরীর দাবি, তিনি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১০ কোটি টাকা।
ডেসটিনি
ডেসটিনির মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান মো. হোসেনকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিয়েছিলেন। ডেসটিনির পক্ষে আজমালুল হক কিউসি প্রস্তাব দেন যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জামিন পেলে ৩৫ লাখ গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারবেন। এ ছাড়া ডেসটিনির ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা দামের ৬৭০ একর জমি আছে বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। আপিল বিভাগ তা মেনে নেন। আদালত রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে ৩৫ লাখ গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা জমা কিংবা গাছ বিক্রি না করে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা দিলে তাঁরা জামিন পাবেন বলে আদেশ দেন।
ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন বোর্ডের সভাপতি ও ডেসটিনির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চাঁদপুর-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ শামছুল হক ভুইয়াকে আপিল বিভাগ গাছ বিক্রির জন্য কারাগারে আসামিদের সঙ্গে আলোচনার অনুমতি দিয়েছিলেন। জানতে চাইলে ডেসটিনির শামছুল হক ভুইয়া মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ৩৫ লাখ গাছ তো লাগানোর আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। সুতরাং, ওই শর্ত পূরণ করা কখনোই সম্ভব ছিল না। তাঁর কথায় আমরা তাই আপিল বিভাগের রায় সংশোধন চেয়েছি।’
রফিকুল আমিন ও মো. হোসেন এখনো জেলহাজতে আছেন।
*ডেসটিনির রফিকুল আমিন ও মো. হোসেনের দেওয়ার কথা ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা
* হল-মার্কের জেসমিন ইসলামকে দিতে হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা
*২৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা সাংসদ শওকত চৌধুরীর
হল-মার্ক
৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। ঢাকার তৎকালীন মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জহুরুল হক ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থ শোধ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা করে পরিশোধের শর্তে দুদকের ১১টি মামলায় জেসমিন ইসলামকে জামিন দেন।
ওই বিচারক মো. জহুরুল হক বর্তমানে বিটিআরসির কমিশনার। তিনি কেবিডিনিউজকে বলেন, ‘যত দূর মনে পড়ে, আদালতে হল-মার্কের আইনজীবীরা জামিন চেয়ে টাকা ফেরতের অঙ্গীকার করেছিলেন।’ ওই আদেশের পর হাইকোর্ট টাকা ফেরতের শর্ত রদ করেন। বর্তমানে অন্য এক মামলায় জেসমিন ইসলাম জেলহাজতে আছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টাকা ফেরতের শর্তে জামিনের বৈধতার প্রশ্ন সুরাহায় জেসমিন ইসলামের মামলাটি বিচারপতি মো. রেজা–উল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে পাঠান। জেসমিনের আইনজীবী ছিলেন রফিক-উল হক। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, প্রচলিত আইনে শর্তসাপেক্ষ জামিন অবৈধ। তবে এর দুই বছর পর ডেসটিনির মামলায় আপিল বিভাগ শর্তসাপেক্ষ জামিন দেওয়ার রীতি সমর্থন করে রায় দেন।
বেসিক ব্যাংক
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ৮২ ব্যবসায়ী। তাঁদের অন্যতম ইউকে বাংলা ট্রেডিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান আহমেদ তাজউদ্দিন। তিনি আগাম জামিন চান। শুনানি শেষে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০১৬-এর ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর আদেশে বলেন, ব্যবসায়ী তাজউদ্দিন বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থ ফেরতে আগ্রহী, কিন্তু জেলে পাঠালে তা সম্ভব হবে না। জামিন আবেদনকারী তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে মুচলেকা দেন যে তিনি প্রতি দুই মাস অন্তর দুই কোটি টাকা জমা দেবেন। নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের দিনে তিনি প্রথম কিস্তির টাকা জমা করবেন। হাইকোর্ট এই শর্তে তাঁকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংকটির প্রায় ৪৫ কোটি টাকা (সুদাসলে ৬১ কোটি টাকা) আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আপিল বিভাগ গত বছরের ১০ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ওই আদেশ সংশোধন করেন। যদিও তাঁরা টাকা দেওয়ার শর্ত নির্দিষ্টভাবে রদ করেননি। আবার নিম্ন আদালতও তাঁকে জামিন দিতে গিয়ে টাকার শর্ত পূরণ আমলে নেননি। সেই অর্থে তিনি প্রতিশ্রুত টাকা না দিয়ে জামিনে আছেন।
জানতে চাইলে ওই মামলায় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান কেবিডিনিউজকে বলেন, যদি ওই ব্যবসায়ী হাইকোর্টের শর্তে টাকা ফেরত দিতেন, তাহলে তা জামিন আদেশে উল্লেখ থাকত। কিন্তু তার কোনো উল্লেখ নেই।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ নিয়ে গত রাতে কেবিডিনিউজকে বলেন, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ক্ষমতাবানেরা যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি উপভোগ করেন, এই নজিরগুলো তারই একটি নতুন রূপ। এর অন্তত দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত আদালতে অঙ্গীকার করে তা প্রতিপালন না করা একটি প্রতারণা, প্রচলিত আইনে যা দণ্ডনীয়। আবার আদালতের আদেশ মান্য না করায় সংবিধান অনুযায়ী তা আদালত অবমাননার অপরাধ তৈরি করে। এই প্রবণতা এখনই রোধ না করা হলে তা রুই-কাতলার দুর্নীতির আরও বেশি বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি করবে।