চামড়া পাচারে সক্রিয় সিন্ডিকেট সংরক্ষণের সঙ্কট

chamraবিশেষ প্রতিনিধি : নানামুখী সঙ্কটে দেশের ট্যানারি শিল্প। আর কোরবানির আগে এই সঙ্কট কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতেই বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে কোরবানির পশুর চামড়া পাচার সিন্ডিকেট। ভারতে কাঁচা চামড়া সঙ্কট উত্তরণে পাচারকারী সিন্ডিকেট চক্র ভালো দর পাওয়ার আশায় এবার বেশ আগ থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশের চামড়া সরবরাহকারীদের অনেকের সাথে চামড়া সংগ্রহের চুক্তি সেরে ফেলেছে-এমনটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

যদিও বাংলাদেশ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া পাচার হওয়া নিয়মিত ঘটনা। তবে এ বছর দেশের ট্যানারিগুলো বেশিরভাগই অক্ষম, সংরক্ষণের সঙ্কট ও চামড়ার ন্যায্য মূল্য নির্ধারণসহ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে কোরবানি পশুর চামড়ার ১টি বড় অংশ পাচার হওয়ার আশঙ্কা করছেন খোদ চামড়া ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছরই ভালো মানের চামড়ার জন্য

ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করেন কোরবানি ঈদের। চামড়া শিল্পের শতকরা ৬৫-৭০ ভাগ কাঁচা চামড়া সংগৃহীত হয় এই কোরবানি ঈদে।

কিন্তু একদিকে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ বন্ধ, অন্যদিকে অপ্রস্তুত সাভারের ট্যানারি পল্লী। ফলে আসন্ন ঈদে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে সঙ্কট দেখা দেবে। গত বছরও একই ধরনের সমস্যায় ভারতে পাচার হওয়ার পাশাপাশি সঠিক সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়েছিল কোরবানির মৌসুমের প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ চামড়া। তাই আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এবারও চামড়া পাচারের পাশাপাশি কাঁচা চামড়া নষ্টের হারও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এদিকে সাভারের ট্যানারি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, হাজারীবাগের ক্ষত কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে ট্যানারি শিল্পের নতুন ঠিকানা সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। তবে গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় সাভার চামড়া শিল্প নগরীর বেশিরভাগ ট্যানারি কারখানা এখনও পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) দেয়া তথ্য বলছে, ১৫৪টি ট্যানারির মধ্যে উৎপাদন শুরু হয়েছে ৫৫টির।

আসছে ঈদে কোরবানির পশুর চামড়া প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে আরও ২৫ থেকে ৩০টি কারখানা। তবে এর মধ্যে শুধু ২২টি কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে গ্যাস সংযোগ না পাওয়া ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চামড়া প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও গ্যাসের অভাবে ফিনিশিংয়ের কাজ করা যাচ্ছে না। ফলে থমকে আছে রফতানি। এতে কোটি কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, আসন্ন কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কারখানা প্রস্তুত নয়। এই বাস্তবতায় কেউ চামড়া কিনবে না। তিনি বলেন, পোস্তার আড়তদার ও বেপারিরাই এখন ভরসা। আড়ত মালিকরা চাইলে চামড়া কিনে তা মজুদ করতে পারবে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ জানান, নানা ইস্যুতে এবার কাঁচা চামড়া নিয়ে সঙ্কট দেখা দেবে। আর গ্যাসের কারণে কোনো ট্যানারি মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জন্য বিসিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র মতে জানা গেছে, গত ৩ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতের কয়েকটি প্রদেশে গরু জবাই বন্ধ থাকলেও ট্যানারি বন্ধ হয়নি। ফলে বেড়েছে কাঁচা চামড়ার সঙ্কট। ভারতের বামতলা, কানপুর, চেন্নাই ও পাঞ্জাবে কয়েক হাজার ট্যানারি আছে। ২০১৪ সালের মে মাসে দেশটি বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধের নির্দেশ দেন। একইসাথে ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। এতে ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার সঙ্কট তৈরি হতে থাকে। সম্প্রতি সঙ্কট কাটাতে কাঁচা চামড়া আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। আর এ সুযোগে আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চামড়া পাচারকারী চক্র। অনেক ভারতীয় ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অগ্রিম অর্থ দিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে আগেই চুক্তি করেছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে তাই ভারতীয় বস্নাকাররা চামড়া পাচারে এবার আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের চোরাচালানীরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মোকামে বস্নাকে চামড়া নিতে অর্থলগি্ন করছে। খুলনাঞ্চলের সীমান্ত তথা অবৈধ ঘাটগুলো দিয়ে প্রতি বছর চামড়া পাচার হয়।

সাতক্ষীরার সীমান্তগুলো দিয়ে গরু আসা বন্ধ হলেও ভারতের অসাধু ব্যবসায়ীরা গরু দেয়ার বদলে চামড়া নিতে এখন মরিয়া। কলোবাজারি চামড়া ব্যবসায়ীরা তাই নড়েচড়ে বসেছে। এদিকে ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা, লবণের মূল্য বৃদ্ধি, পুঁজি সঙ্কট, ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির টাকা সময়মতো না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে সুযোগ বুঝে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের চামড়া বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে কোটি কোটি টাকার পুঁজি লগি্ন করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলো থেকেই আসে বিরাট অংশের কাঁচা চামড়া। পরিবহণ খরচ মেটানোর ভয়ে সীমান্ত অঞ্চলের চামড়া স্থানীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার জন্য ভারতে চামড়া বিক্রি করা তুলনামূলক সহজ।

এ ক্ষেত্রে অনেক পুঁজিপতিরা হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খুলনাঞ্চলে বিনিয়োগ করছে। এ কারণে এবারও কোরবানির চামড়া খুলনাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র মতে, দেশে-বিদেশে চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অমিত সম্ভাবনা রয়েছে শিল্পটির। চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ পরিবার। পরিকল্পিতভাবে চামড়া ক্রয় বিপণন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানির প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। ঈদুল আযহা উপলক্ষেই প্রতিবছর চামড়ার সবচেয়ে বড় যোগান সৃষ্টি হয়। এই মহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখেই প্রতিবছর কালোবাজারীরা তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের ফাঁদ পাতে। আর সেই ফাঁদেই পা দিয়ে থাকেন প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীরা। দেশীয় এই সম্পদকে দেশের কাজে লাগানোর জন্য দাবি জানিয়েছে সুশীল সমাজ।

অপরদিকে ঈদের আগেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। ১ বস্তা লবণ এখন কিনতে হচ্ছে ১২৫০ টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত এই চামড়া শিল্পের উন্নয়নে ব্যবসায়ীদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের রাজস্ব কমবে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post