বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির রেকর্ড

খাদ্য মন্ত্রণালয়

স্টাফরিপোটার: দেশের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য চালের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। ফলে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে চালের দাম। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের খাদ্য মোটা চালসহ সব ধরনের চাল স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। দেশে ভয়াবহ এ চাল বিপর্যয়ের কারণে মোটা চাল কিনতে হলেও গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকারও বেশি। ফলে বেড়ে গেছে নিত্যদিনের বাজার খরচ, কষ্টে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এমনিই প্রেক্ষাপটে চালের বাজার কড়া নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্যে মূলত চাল ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ধানের উৎপাদন কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আর কিছু অসাধু মিল মালিক যোগসাজশ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি করেছে।
দেশের মানুষের মূল খাদ্য ভাত, আর তাই চালের দাম দেশটিতে সব সময় একটি রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয়। তবে চালের দাম সরকারের জন্যে ‘রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ হবে না বলেই বিশ্বাস করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সংকট আছে আমি স্বীকার করি। তবে আমদানি করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারতাম তাহলে সংকটটা সৃষ্টি হতো তিন-চার মাস পরে। এখন যে সংকট সেটা কৃত্রিম সংকট বলেই দাবি কামরুল ইসলামের। এদিকে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বাজারে সরু চালের কেজি ছিল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। এ সপ্তাহে তা ২ টাকা বেড়ে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের দাম ৪৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৮ টাকা। সব ধরনের চালের দাম গত এক মাসে ৪ থেকে ৮ শতাংশ এবং এক বছরে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর দেশে মোটা চাল সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। আর চিকন চাল বিক্রি হয়েছিল ৫৬ টাকা কেজি দামে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা শাসন আমলে চালের এ দর আরো বাড়ে। তবে এবার বর্তমান সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে প্রতি কেজি চালের দাম ১০ টাকা বেশি হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে চাল আমদানি কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬-এই দুই অর্থবছরে দেশে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। ঐ সময়ে দেশে চালের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। আর এখন চালের কেজি ৫০ টাকা ছুঁইছুঁই করলেও গত এক বছরে মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর লালবাগ ও শান্তিনগর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের প্রধান খাদ্য মোটা চাল স্বর্ণা প্রতি কেজি ৫০ টাকা, পাইজাম ৫০ থেকে ৫২ টাকা, চায়না ইরি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পারিজা ৫০ টাকা, বিআর২৮ ৫০ টাকা, মিনিকেট একটু ভালো মানের ৫৮-৬২ টাকা, মিনিকেট (সাধারণ) ৫৪-৫৫ টাকা, নাজিরশাইল ৫৪ টাকা, নাজিরশাইল ৫৬ থেকে ৬২ টাকা, বাসমতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, কাটারিভোগ ৭৮ টাকা, হাস্কি নাজির চাল ৫৪ টাকা এবং পোলাও চাল খোলা ৯০-১০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে চালকলের মালিকরা বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন- হাওড় অঞ্চলে ফসলহানি, বিভিন্ন জায়গায় ধান চিটা হয়ে উৎপাদন কম হওয়া এবং ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া।

তবে দেশের অন্যতম কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান এসব যুক্তি পুরোপুরি গ্রহণ করছেন না। এটা সত্যি হাওড় এলাকাসহ কিছু জায়গায় দুর্যোগ হয়েছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু এমন কিছু হয়নি যাতে হুহু করে দাম বাড়বে।

তার মতে, চালকল মালিকরা আংশিক সত্য, কিন্তু আরো যোগসাজশ থাকতে পারে। বাজার সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। সেটি প্রমাণিতও হয়নি, অপ্রমাণিতও হয়নি … চালের এত অভাব হয়নি আর এমন কিছু দুর্যোগ হয়নি। হাওড় এলাকার ধান উৎপাদন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

জানা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিকের সঙ্গে বোরো চাল সংগ্রহের জন্য চুক্তি করে সরকার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সরকারি গুদামে ৮ লাখ টন চাল সরবরাহ করবে। কিন্তু ঘোষণার একমাস সময় পেরিয়ে গেলেও গুদামে ঢুকেছে মাত্র ৭ হাজার ২৭৮ টন চাল।

কারণ চাল কলের মালিকরা সরকারের কাছে চাল বিক্রি করতে আগ্রহী নয়। মিল মালিকরা স্বীকার করেছেন, সরকার চাইলেও দামের কারণে তারা সরকারকে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। সরকার কেজিপ্রতি ৩৪ টাকা দিতে চাইছে যা বাজার দরের চেয়ে অনেক কম। ধানের রেট যেখানে ২৪ টাকা সেখানে চালের রেট মিনিমাম ৩৮ টাকা হতে হবে।

সরকারের চালের মজুদ না বাড়ালে পরিস্থিতি সঙ্গিন হতে পারে বলে সাবধান করলেন ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, তার জানা মতে সরকারের হাতে তিন লাখ টনেরও কম পরিমাণ চালের মজুদ রয়েছে। সরকারের হাতে চাল নেই, এ খবরে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়বে, সংশয় বাড়বে, ফলে দাম আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে চাল আমদানি করছে সরকার। তবে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা মনে করেন, আমদানি করা চাল ৩০ জুনের মধ্যে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও আপতকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহেও আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছে না খাদ্য মন্ত্রণালয়।

তবে বিদেশ থেকে চাল আমদানির এই সিদ্ধান্ত কতটা কাজ দেবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ড. আসাদুজ্জামান। তার সন্দেহের প্রধান কারণ সরকারি দফতরের দীর্ঘসূত্রতা। ফাইল চালাচালি করতে এক দেড় মাস যাবে, তারপর চাল আসবে বন্দরে, খালাস হবে, তারপর এলএসডি, সিএসডিতে যাবে, তারপর সরকার তা বাজারে ছাড়বে… দুই-তিন মাসের ধাক্কা।

Post a Comment

Previous Post Next Post