হুমকির মুখে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা

 

জীবন ও জীবিকা

স্টিাফরিপোটার: উজানে গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের ফলে মরে গেছে নদী তিস্তা। এ নদীর পাড়ে দাঁড়ালে এখন শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস।

সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে এই মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেচ দেয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ প্রদান করা হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।

বোরো আবাদের মোক্ষম সময়ে কমান্ড এলাকায় কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা পড়েছে বিপাকে। গত কয়েকদিন আগেও নদীর পানি প্রবাহ প্রায় আড়াই হাজার কিউসেক থাকলেও তা সোমবার মাত্র ৪০০ কিউসেকে নেমে এসেছে বলে জানা যায়। তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ দিন দিন কমতে থাকায় এবার মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে।

এরমধ্যে নীলফামারী সদরে ৮শ হেক্টর, ডিমলা উপজেলার ৫ হাজার হেক্টর, জলঢাকা উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ২শ হেক্টর। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে। সেক্ষেত্রে সেচের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। জমি তৈরি থেকে চারা রোপণ এবং আবাদ চলমান পর্যন্ত প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এখন তিস্তায় পানি নেই। তাই সেচ প্রকল্পের সেচের আশা বাদ দিয়ে নিজেরা সেচযন্ত্র (শ্যালো) ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে।

ডিমলা উপজেলার নাউতরা ইউনিয়নের সাতজান গ্রামে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রধান খালের পাশের কৃষক বেলাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, উজানের প্রবাহ না থাকায় তিস্তা সেচ প্রকল্প আগের মতো পানি দিতে পারে না। ফলে নিজস্ব সেচযন্ত্র দিয়ে এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করতে খরচ হবে ৫ হাজার টাকা।

সূত্র বলছে, তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০০ কিউসেক। কিছুদিন আগেও তিস্তা ব্যারেজে পানির স্তরের পরিসীমা ১০০০ থেকে ১২০০ কিউসেক ছিল। বর্তমানে তিস্তায় পানি সংকটের কারণে বোরো আবাদি কৃষকরা ব্যাপক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে দারিদ্রপীড়িত উত্তরাঞ্চলের মানুষের রুটি ও রুজির বিষয় বিবেচনা এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ় করতে জরুরি ভিত্তিতে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি সই এবং তা পরিপূর্ণভাবে কার্যকরের দাবি জানিয়েছে দেশের বিশেষজ্ঞ মহল ও সাধারণ মানুষ।

এদিকে, ‘প্রতিবেশী প্রথম’ এ নীতিতে বিশ্বাসী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। ঐ সফরে দুই দেশের মধ্যকার ৪১ বছরের পুরনো সীমান্ত সমস্যা সমাধান হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভারত সফরের সময় একই ধরনের ঐতিহাসিক তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। তবে ঐ চুক্তি ভারতের রাজ্য সরকার পর্যায়ে আটকে যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী এপ্রিল মাসে আবারও ভারত সফরে যেতে পারেন। ঐ সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির প্রত্যাশা করলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, এবারও তা হচ্ছে না।

তথ্য মতে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আলোচনার টেবিলে না আসায় কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ সফরে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হবে না। এমন খবরে তিস্তা পাড়ের লোকজনের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। তিস্তা পাড়ের কৃষক ও স্কুল শিক্ষক সফিয়ার রহমান জানান, শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সাথে সফলতা নিয়ে সব চুক্তি করে বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করলেও আজ কাল করে বছরের পর বছর পার হচ্ছে কিন্তু তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। পানির অভাবে তিস্তা র‌্যারাজ সেচ প্রকল্প থেকে রংপুর-দিনাজপুরকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও পানি সংকট কাটছে না। আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে তিস্তার পানি চুক্তির জন্য? শুনলাম এবারও না কি তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বহু আলোচিত এ চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। চুক্তিটি না হওয়ায় বাংলাদেশের হতাশার কথা দিল্লীকে বেশ স্পষ্টই জানিয়ে দেয়া হয় সে সময়। হতাশা প্রকাশ করেন মনমোহন সিংও।

মমতাকে রাজি করাতে এরপর দিল্লীর পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিজেও কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। কিন্তু তিস্তা চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে অনড় থাকেন মমতা।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রেক্ষিতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও নেয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি।

সূত্র মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির জটিলতার ফলে পানি সংকটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেজ্ঞরা। শুষ্ক মৌসুমে তিস্ত নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা কৃষিকাজে পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। পরিবেশগত প্রভাবের কারণে এ পরিস্থিতি দিন-দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ার প্রভাব থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে ন্যায়সঙ্গত এবং সুষম পানি বণ্টন চুক্তিতে সই ও তা কার্যকর করার জন্য ভারতকে আহ্বান জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ এবং দেশের মানুষ। গত কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশ ভারতকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চুপ ভারত।

সূত্র মতে, সম্ভাবনা জাগিয়েও বারবার থেমে থাকছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। চুক্তি না থাকায় বিগত সময়ের মতো এবারও চলতি মৌসুমে নদীর পানি হাস পাচ্ছে। ফলে তিস্তা নদী ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post