সুন্দরবনে পাশ-পারমিটের অতিরিক্ত গোলপাতা আহরণের অভিযোগ বাওয়ালীদের বিরুদ্ধে

বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: সুুন্দরবনে গোলপাতা কাটার মৌসুমে প্রথম পর্যায়েই অতিরিক্ত মলম লাগানো নৌকা উঠছে জল দাগ ডুবিয়ে। পাশ-পারমিটে নির্ধারিত পরিমাণের কয়েকগুণ গোলপাতা আহরণে রীতিমত উজাড় হচ্ছে সুন্দরবন। গোলপাতা কাটার মৌসুমকে বনরক্ষকদের বাড়তি আয়ের একটি “গোল্ডেন সিজন” হিসেবে খ্যাত। কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের বাড়তি চাপ (উৎকোচের) যোগান দিতে বাওয়ালীরা বাধ্য হচ্ছেন অতিরিক্ত আহরণে। তাদের অভিযোগ, গোলপাতা বোঝাই নৌকা কূপে ফাইনাল করাতে গেলে কর্মকর্তাদের উৎকোচ ‘ওপেন সিক্রেট’। টহলটীম, স’ানীয় ফাঁড়ি, স্টেশন অফিস ও রেঞ্জ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটে চেকিংয়ের নামে হয়রানি করা হয়, তবে টাকা দিলে চেক করা হয় না। নানা অপকৌশলে ওভার লোডিংয়ের ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

সংশ্ল্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাশ-পারমিটে ফরেস্ট স্টেশনের সরকারি রাজস্ব মণ প্রতি ১০ টাকা; সেখানে স্টেশন কর্মকর্তা গ্রহণ করছে মণ প্রতি অতিরিক্ত আরো ৮ থেকে ১০ টাকা। সে হিসেবে উৎকোচ আদায় হয় কয়েক লাখ টাকা। এ ছাড়া ৫০০ মণ নৌকায় জলদাগ ডুবিয়ে অতিরিক্ত মলম বা তক্তা লাগিয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা বোঝাই করে আনছে বাওয়ালীরা। সেটার জন্য মৌখিক চুক্তি থাকে তাদের। কূপের উৎকোচ থেকে রেঞ্জ কর্মকর্তা গ্রহণ করছে মণ প্রতি ৪/৫ টাকা। এ টাকা কূপে কমর্রত স্টাফদের ভিতরে ভাগ বাটোয়ারা হয়। নৌকার দু’পাশে ৪টি গেঁওয়া গাছ ঝুল হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি থাকলেও সেখানে বাওয়ালীরা ব্যবহার করছে যথেচ্ছা। পছন্দ মতো সুন্দরী গাছ কেটে নিয়ে আসছে জ্বালানী কাঠ হিসেবে, যা কম কক্ষে ২০ থেকে ৫০ মণ প্রতি নৌকা। অথচ এর কোন রাজস্ব দিচ্ছে না বাওয়ালীরা। নৌকা বন থেকে বের হবার সময় চেকিংয়ের নামে অর্থ আদায়, অনাদায়ে সীমাহীন ভোগানি-। তবে উৎকোচ দিলে চেক করা হয় না নৌকা। এ সুযোগে বাওয়ালী আনছে গোলপাতার নিচে কর্তন নিষিদ্ধ সুন্দরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ। উৎকোচ বিনিময়ের এসব ঘটনা কোন প্রকার প্রকাশ করলে বাওয়ালীকে নানানভাবে নাজেহাল করবে; এমনি ভয়ে কেউ নাম ঠিকানা প্রকাশও করতে সাহস পায় না। কিন’ “ব্যবসা হোক, না হোক! সুন্দরবন সুন্দর থাক না থাক! বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে খুশি করতেই হবে বলে অভিযোগ কয়রার গোলখালি গ্রামের বাওয়ালী সানা আলতাফ হোসেন মিন্টুর। পাশে পাঁচশ’ মণ উল্লেখিত নৌকায় অন-ত এক হাজার থেকে ১২শ’ মণ গোলপাতা প্রথম টিপেই এসেছে বলে জানিয়েছেন বাওয়ালীরা।
আবার, পাতা বোঝাই নৌকা ফাইনালের নামে অর্থ আদায় প্রসঙ্গে বাওয়ালী মোঃ জামাল হোসেন বলেন, “পোত্তেক নৌকোই ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতি হয় কূপ আফিসারকে। এট্টু কমানির কোতা কলি তাই হয়রেনি কোরা হয়।”
বনজীবী ফেডারেশনের আহবায়ক মোঃ বাচ্চু মীর বলেন, “কিছু নৌকায় ৪/৫ ইঞ্চি জল দাগ ডুবিয়ে এনেছে। আমি আনতে পারিনি। ওই ১২/১৮ ইঞ্চি মলম নিয়েছিলাম। তাতে যে মাল (গোলপাতা) এসেছে মনে হয়, লজ (লোকসান) হবে। কূপে ওই আগের মতোই (উৎকোচ) মণ প্রতি ৮/১০ টাকা দিতে হয়েছে।” শেষে বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার সাথে উৎকোচ লেনদেনের অভিযোগ উঠছে জানালে, অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, গত ৫ বছর গরানের পাশ পারমিট বন্ধ রয়েছে। চলছে গোলপাতা আহরণ। গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম দফায় গোলপাতা আহরণের পাশ-পারমিট দেয় বনবিভাগ। চলতি মৌসুমে গোলপাতার পাশ-পারমিট দেবার পূর্বেই বনবিভাগের ব্যবস’াপনা ও পরিকল্পনা বিভাগ সুন্দরবনে আহরণযোগ্য গোলপাতার সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ভয়ে জরিপ করে। সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের সর্বমোট ৫৫টি কম্পার্মেন্টের ৬টি কূপে জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সুন্দরবন লন্ডভন্ড হলে সরকার ওই বছর থেকে গরানের পারমিট বন্ধ করে। তবে গোলপাতা সংগ্রহের পারমিট চালু ছিল। সর্বশেষ, গেল অর্থ বছরে পশ্চিম বনবিভাগ থেকে ৩৪ হাজার ৫৫ মেট্রিক টন গোলপাতা আহরণ হয়। যার বিপরীতে সরকার ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৩৪ টাকা রাজস্ব আয় করে।
সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের ব্যবস’াপনা পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানান, সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের তিনটি কূপের সাতক্ষীরা গোলপাতা কূপে ৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, আড়-য়া শিবসা কূপে ৭ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ও শিবসা কূপে ৬ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন এবং পূর্ব বনবিভাগের তিনটি কূপের শরণখোলা রেঞ্জে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, চাঁদপাই রেঞ্জে ১৫ হাজার মেট্রিক টন ও শ্যালা রেঞ্জে ১৭ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা মজুদ ছিল।
পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সাঈদ আলী বলেন, আমি নিজে রেঞ্জে গিয়ে বড় নৌকা দেখেছি। অতিরিক্ত মলম ব্যবহার করতে দেইনি। জলদাগ ডুবিয়ে অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ করেননি। বাওয়ালীদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলাম-অতিরিক্ত মলম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে। কোন প্রকার অনিয়ম ধরা পড়লেই আইনানুগ ব্যবস’া নেয়া হবে।
সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সাইদুল ইসলাম বলেন, নৌকার পেট কাটা দৈর্ঘ্য-প্রস’ বাড়ানো ও অতিরিক্ত মলম ব্যবহারের নির্দিষ্ট অভিযোগ পাইনি; পেলে আইনানুগ ব্যবস’া নিবো।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post