অর্থ পাচারের তালিকায় ৩৪ বাংলাদেশি

KBDNEWS ডেস্ক : পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া চাঞ্চচল্যকর গোপন নথিতে বাংলাদেশের ৩৪ জন ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, যাদের বিপরীতে মোট ৪৫টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এদের মধ্যে ২৩ জনের বাড়ির ঠিকানাও উল্লেখ আছে। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, ৪ ব্যক্তির নামে দুইটি করে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যৌথ অ্যাকাউন্ট রয়েছে দুটি।

এতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও একজন এমপির নাম রয়েছে। কাজী ‘পানামা পেপারস’ নামে ওসব নথি প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। ঐ তালিকায় বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রপ্রধানসহ শতাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও আত্মীয়স্বজনের কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রমাণ রয়েছে।

জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতংয়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিক বাস্তিয়ান ওবারমেয়ারের হাতে এসব নথি আসে। তারা এটাকে তুলে দেন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংস্থা আইসিআইজের কাছে। পরবর্তীকালে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, বাংলাদেশের নিউএইজসহ ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদমাধ্যম এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে। গত সোমবার ১ কোটি ১৫ লাখ নথি প্রকাশ করা হয়। খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, গার্ডিয়ান ও আইরিশ টাইমসের। মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া নথিগুলো বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। নথিতে বিশ্বের শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তালিকায় দেখা গেছে যে চীন, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের আত্মীয়, খেলোয়াড়, অভিনেতাসহ ধনী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। আইসিআইজের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত বৈশ্বিক অর্থপাচারের তালিকায় বাংলাদেশের ২৫ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার কথা জানানো হয়। আইরিশ টাইমসের ডিজিটাল প্রডাকশনবিষয়ক সম্পাদক ব্রায়ান কিলমার্টিনের তৈরি গ্রাফিকস ম্যাপে বাংলাদেশের ৩৪ জন ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, যাদের বিপরীতে মোট ৪৫টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আইসিআইজের ওয়েবসাইট ও কিলমার্টিনের গ্রাফিকসে বাংলাদেশের এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে সেখানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের লিংক দেয়া আছে। সেসব লিংকে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশের অনেকেই বিদেশে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে।

ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সহযোগী বাংলাদেশের নিউএইজ পত্রিকা এসব তথ্য হাতে পেয়ে যাচাই-বাছাই করে। নথিগুলো হাতে পাওয়ার পর প্রাথমিক পর্যালোচনার পর ‘লোকাল বিজনেসমেনস লিংক টু অফশোর কোম্পানিস রিলিভলড’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

আইসিআইজের হস্তগত গোপন নথি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী বিদেশে কোম্পানি স্থাপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরের নাম। তবে জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী উভয়েই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এছাড়া মার্কেন্টাইল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, কন্যা আয়েশা আজিজ খান, ভাই জাফর উমায়েদ খান ও ভাগ্নে ফয়সাল করিম খান বিদেশে মোট ছয়টি কোম্পানি চালান। এর মধ্যে ব্রিটিশ ভার্জিন আইসল্যান্ডের কোম্পানি সিঙ্গাপুরের ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করা হয়েছে। এসব কোম্পানি অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। তবে আজিজ খান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তাদের কার্যক্রম আইনসম্মত বলে দাবি করেন।

বিদেশে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা আরও যেসব অর্থপাচারকারীর নাম ঐ তালিকায় দেয়া আছে, সেগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড গ্রুপ অব কোম্পানির হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মঈনুল আহসান (শামীম), আহমেদ ইসমাইল হোসেন, আখতার মাহমুদ, স্কয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. এএমএম খান, মমিন টির পরিচালক আজমত মঈন, পাট ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার মোদি, সি পার্ল লাইন্সের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, বাংলা ট্রাক লিমিটেডের মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক ইকরামুল হক, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার ক্যাপ্টেন সোহাইল হাসান, মাসকট গ্রুপ অব কোম্পানির চেয়ারম্যান এফএম জোবায়দুল হক, সেতু কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, তার স্ত্রী উম্মে রব্বানা, স্পার্ক লিমিটেড ও অমনিকেমের চেয়ারম্যান ইফতেখারুল আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেডের নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম, তার স্ত্রী আসমা মোনেম এবং অনন্ত গ্রুপের শরীফ জহির।

এছাড়াও এএফএম রহমাতুল্লাহ বারী, ক্যাপ্টেন এমএ জাউল, সালমা হক, কাজী রায়হান জাফর, মির্জা এম ইয়াহইয়া, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, সৈয়দা সামিনা মির্জা ও জুলফিকার হায়দার। আর প্রতিষ্ঠানটি হলো-বিবিটিএল। এদিকে, পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া চাঞ্চচল্যকর গোপন নথির বিষয়টি তদন্ত করবে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউটর অফিস। পানামার প্রসিকিউটর অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘পানামা পেপারস’ নামে খ্যাত প্রতিবেদনে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তার ফৌজদারি তদন্ত করা হবে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তদন্তের উদ্দেশ্য হবে-কী ধরনের অপরাধ হয়েছে এবং কারা এর সাথে জড়িত আর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি নিরূপণ করা। মোসাক ফনসেকা বলেছে, তাদের সার্ভার ‘সীমিত হ্যাংকিংয়ের’ শিকার হয়েছে। এর সাথে বাইরের কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা র‌্যামন ফনসেকা বলেছেন, নথি ফাঁস পানামার ওপর একটি হামলা। দেশটি তাদের অর্থনৈতিক সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল। পানামার প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস ভ্যারেলা বলেছেন, বিষয়টি তদন্তে তার দেশ সহায়তা করবে। তবে তিনি তার দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার অঙ্গীকারও করেন। পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। প্রশ্ন উঠেছে পানামা পেপারসের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এর উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকরা বলছেন, ফনসেকা নাম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, সিরিয়া, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, চীন, পাকিস্তান, মিসরের মতো দেশগুলোকে নিচু করতেই এই নথি ফাঁস করা হয়েছে। আইসল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ছাড়া এখানে আর কোনো পশ্চিমা দেশ নেই। অনেক তাত্তি্বক এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। এর সপক্ষে তারা যুক্তিও হাজির করেছেন। সেটি হল, ফনসেকার নথিতে কোনো মার্কিন নেতার নাম নেই। ন্যাটো বা জাতিসংঘের কোনো দুর্নীতিরও উল্লেখ নেই।

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post