বঙ্গবাজারে আগুন, নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা

 


               বঙ্গবাজারে আগুন, নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা

KBDNEWS রিপোর্ট   

 

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবাজার এলাকায় যেতেই চোখে পড়ে মেহেদীর আহাজারি। তিনি বলেন, আমার দোকানটি ছিল সামনে, ফলে ভেতরের ব্যবসায়ীদের চেয়ে আমার ব্যবসাও ভালো ছিল। এখন আর কিছুই নেই। আমি ফকির হয়ে গেছি। মেহেদী হাসানের মতো নিঃস্ব হয়েছেন ৫ হাজার ব্যবসায়ী। কীভাবে ঘুড়ে দাঁড়াবেন এই ব্যবসায়ীরা? অন্তত দোকানটি টিকে থাকলে যেভাবেই হোক ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। এখন তো কিছুই নেই। কবে তৈরি হবে দোকান, কীভাবে টাকার সংস্থান হবে, কবেই বা ব্যবসা শুরু করবেন—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তাদের কাছে। কিছু সহযোগিতা পেলেও সেটা দিয়ে কী করবেন? কোথায় ব্যবসা করবেন? সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, এখানে বহুতল ভবন করে দেওয়া হবে। সেই ভবনে কী ঠাঁই মিলবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের? এর কোনো উত্তর তারা জানেন না। ফলে ঈদের আগেই চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে গেছেন তারা।এদিকে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এই তালিকা করা হচ্ছে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে নাম তালিকাভুক্ত করাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতার পাশাপাশি মার্কেটের জায়গা বুঝে পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের পাশের রাস্তায় যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের নিচে অস্থায়ী বুথ বসিয়ে নাম নিবন্ধনের এই কাজ শুরু করে বঙ্গবাজারের বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি। সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তারা সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলেন। দুপুরের দিকে তালিকার কাজ করা শুরু হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা আদর্শ হকার্স মার্কেট, মহানগরী, বঙ্গ ও গুলিস্তান—এই চার অংশের ব্যবসায়ীরা পৃথক সারিতে দাঁড়িয়ে নাম নিবন্ধনের কাজ করছেন। নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য অনেককে হুড়োহুড়িও করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবকিছু তো শেষ। এখন যদি কোনো সাহায্য সত্যিই আসে, তাহলে নাম নিবন্ধন করতে না পারলে তা থেকেও তারা বঞ্চিত হতে পারেন। সেজন্য সবাই চেষ্টা করছেন, যাতে কোনোভাবেই নাম বাদ না যায়। ব্যবসায়ীর নাম এবং মোবাইল নম্বরের সঙ্গে তালিকাভুক্তির সময় দোকানের নম্বর ও ভিজিটিং কার্ডও চাইছেন তালিকা তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা।মহানগরী মার্কেটের মাইমুনা গার্মেন্টসের মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই মার্কেটের ছোট ব্যবসায়ীদের একজন আমি। আমারও ৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে বাকিতে মালামাল দিয়েছিলাম ১০ লাখের মতো। ঐ খাতাও নেই। সম্পদ বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তালিকায় নাম লেখাতে এসেছি। দেখি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই কি না।’ একই মার্কেটের আল মদিনা গার্মেন্টসের মালিক নেয়ামাত উল্লাহ বলেন, ‘দেড় বছরের মতো হলো ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম। ভালোই চলছিল। কত স্বপ্ন ছিল ব্যবসা নিয়ে। এক নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল। সাহায্যের জন্য নাম লেখাতে হবে, এমন কখনো ভাবিনি? অথচ বাস্তবতা আমাকে সাহায্যের তালিকায় নাম লেখাতে দাঁড় করিয়েছে।’ গতকাল দুপুরেও দেখা গেল এনেক্সকো টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সে থেমে থেমে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেখানে আগুন পুরোপুরি নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের সদস্যরা। ভবনটির পঞ্চম থেকে সপ্তম তলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন। মার্কেটের ঐ তিনটি তলায় মূলত কাপড়চোপড় রাখা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঐ তিনটি তলায় বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো আগুনও জ্বলে উঠছে। আর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন। ঐ মার্কেটের যেসব দোকানের পণ্য আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে, সেগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুন নেভানোর চেষ্টার মধ্যেই সকাল থেকে তারা এ কাজ করছিলেন। শ্রমিকদের দিয়ে বস্তাভর্তি বিভিন্ন বস্ত্রপণ্য ও কম্বল ওপর থেকে নিচে ফেলা হচ্ছে। নিচে থাকা কর্মীরা সেগুলো ভ্যান কিংবা ট্রাকে করে অন্যত্র নিরাপদ কোনো জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছেন।

কীভাবে আগুন লেগেছে? জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন নিশ্চিত নই। তবে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছে। আসলে আগুনের প্রকৃত সোর্স যেটি, তা আমরা এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি। মালামাল বের করে আনার কারণে এখনো কোথাও কোথাও একটু একটু আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া হচ্ছে। আগুন সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে পারিনি।’ এনেক্সকো টাওয়ারটি কী এখন ব্যবহারের উপযোগী জানতে চাইলে তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এনেক্সকো টাওয়ারের বিভিন্ন পিলারে ফাটল ধরেছে। সুতরাং এখন রাজউক এবং তাদের ইঞ্জিনিয়ারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং তাদের অনুমতি ছাড়া পুনরায় ভবনে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা যাবে না।’

দেশের পোশাকের অন্যতম বড় পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজার এখন আগুনে পোড়া এক খণ্ড ধ্বংসস্তূপ। ঈদের আগে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড দেশের ঈদ বাজারে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষত ভারতীয় পোশাক ও ছেলেদের পোশাকের দাম বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কা করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বঙ্গবাজার দেশের অন্যতম বড় পাইকারি মার্কেট। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা বঙ্গবাজার থেকে পোশাক সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে ভারতীয় পোশাকের বড় জোগানদাতা বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগে এই মার্কেট আগুনে পুড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পোশাকের দাম বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post