বিবিসি ঃ পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, চীন,
জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত ও জাপানের কোম্পানিগুলোও এ তালিকায় রয়েছে বলে জাতিসংঘের
সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, দেশে তৈরি এসব অস্ত্র সামরিক বাহিনীর বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা
চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে
মিয়ানমার সহিংসতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির নির্বাচিত
সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। অভ্যুত্থানবিরোধীরা প্রান্তীয় নৃ-গোষ্ঠীগুলোর
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতিতেও জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র এই সামরিক বাহিনীর কাছে
অস্ত্র বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী
দেশেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উৎপাদন করতে পারে, আর সেগুলো বেসামরিকদের বিরুদ্ধে
ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে যেসব কোম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে কাঁচামাল, প্রশিক্ষণ ও মেশিনপত্র সরবরাহ করে থাকে; এর
ফলে যে অস্ত্রগুলো তৈরি হয় তা তাদের সীমান্ত রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয় না। ইন
দিন হত্যাকাণ্ডে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো মিয়ানমারেই তৈরি বলে
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে।প্রতিবেদনটির অন্যতম লেখক এবং জাতিসংঘের
মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক ইয়াংহি লি ব্যাখ্যা করে বলেন, কোনো রাষ্ট্র
মিয়ানমারকে কখনো আক্রমণ করেনি আর মিয়ানমার অস্ত্র রপ্তানিও করে না। ১৯৫০ সাল থেকেই
তারা নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিজেরাই অস্ত্র তৈরি করে আসছে।
সর্বশেষ অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত
সরকারিভাবেই সামরিক বাহিনীর হাতে ২ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে
নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর ১০ গুণ বেশি বলে মনে করা হয়।বিবিসির বার্মিজ বিভাগের
প্রধান সোয়ে উয়িন তান বলেন, যখন শুরু হয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল সামরিক বাহিনীবিরোধী
আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে পারবে, কিন্তু সাম্প্রতিক মাস ও সপ্তাহগুলোতে স্রোত
কিছুটা হলেও উলটে গেছে। বিরোধীদের দুর্বলতা হলো তাদের বিমান শক্তি নেই, আর জান্তার
তা আছে। অভ্যুত্থানের পর আরোপ করা কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাও
মিয়ানমারের শাসকদের স্নাইপার রাইফেল, বিমান বিধ্বংসী কামান, মিসাইল লঞ্চার,
গ্রেনেড, বোমা ও স্থলমাইনের মতো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উৎপাদন থেকে বিরত রাখতে
পারেনি।
ইয়াংহি লির সঙ্গে মিলে ক্রিস সিদোতি ও মারজুকি
দারুসমান প্রতিবেদনটি লিখেছেন। সিদোতি ও দারুসমান দুই জনেই জাতিসংঘের
মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য। প্রতিবেদন
তৈরিতে উৎস হিসেবে তারা ফাঁস হওয়া সামরিক নথি, সাবেক সেনাদের সাক্ষাৎকার ও
কারখানাগুলোর স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করেছেন। অমূল্য উৎস হিসেবে বিভিন্ন ছবিও
ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গ্রহণ করা ছবিগুলো থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়,
অভ্যুত্থানের আগেও নিজেদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতেন তারা।
ইন দিনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাদের
মিয়ানমারের তৈরি রাইফেল বহন করতে দেখা গেছে, ঐ সময় তারা ১০ জন নিরস্ত্র রোহিঙ্গা
পুরুষকে হত্যা করেছিল। ক্রিস সিদোতি বলেন, অতি সম্প্রতি সাগাইং অঞ্চলে নির্বিচার
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে একটি স্কুলে বোমা ও গোলাবর্ষণে বহুসংখ্যক শিশু
অন্যান্য মানুষ নিহত হন। সেখানে বোমা ও গোলার যেসব খোল আমরা পেয়েছি, সেগুলো তাদের
কারখানা থেকে এসেছে বলে পরিষ্কারভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছিল। এসব অস্ত্র তৈরির কিছু
উপকরণ অস্ট্রিয়া থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। নিখুঁতভাবে লক্ষ্যস্থল নির্ধারণের
যন্ত্রপাতিগুলো অস্ট্রিয়ার সরবরাহকারী জিএফএম স্টেয়ারের তৈরি, এগুলো বন্দুকের
ব্যারেল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি স্থানে এগুলো পাওয়া গেছে বলে বিশেষ
উপদেষ্টা পরিষদ জানিয়েছে। এসব যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ কাজের দরকার হলে সেগুলো
জাহাজযোগে তাইওয়ানে পাঠানো হয়, সেখানে জিএফএম স্টেয়ারের প্রযুক্তিবিদরা সেগুলো
সারাই করে আবার মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেয়।
তবে প্রতিবেদনে যে তথ্য এসেছে, সে বিষয়ে
মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি জিএফএম স্টেয়ার।
প্রতিবেদনটির লেখকরা স্বীকার করেছেন, তারা
অস্ত্র উৎপাদনের পুরো নেটওয়ার্কের একটি ভগ্নাংশ মাত্র উন্মোচন করেছেন, কিন্তু এতে
বহু সংখ্যক দেশ জড়িত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারে অস্ত্র তৈরিতে চীনের
কাঁচামাল ব্যবহৃত হচ্ছে বলে শনাক্ত হয়েছে। এসব অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত লোহা ও তামা
চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। ফিউজ ও ইলেকট্রনিক ডেটোনেটর ভারতীয়
ও রাশিয়া কোম্পানিগুলো সরবরাহ করেছে। সরবরাহের রেকর্ড ও সামরিক বাহিনীর সাবেক
কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের অস্ত্র কারখানাগুলোতে
যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো জার্মানি, জাপান, ইউক্রেন ও
যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে বলে বলা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনার সফটওয়্যারগুলোর
উৎস ইসরাইল ও ফ্রান্স। এসব ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর ট্রানজিট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত
হচ্ছে বলে প্রতিবেদটিতে বলা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের সামরিক
ক্রেতা ও বাইরের বিশ্বের সরবরাহকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।
কয়েক দশক
ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বহু ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকলেও
তারা কখনোই অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করেনি, বরং তাদের অস্ত্র কারখানার সংখ্যা আরো
বেড়েছে। ১৯৮৮ সালে ছয়টি অস্ত্র কারখানা থাকলেও তা বেড়ে এখন ২৫টির মতো হয়েছে।