পাঞ্জশিরে ৭০০ তালেবান যোদ্ধা নিহত

পাঞ্জশিরে ৭০০ তালেবান যোদ্ধা নিহত

আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য প্রদেশ পাঞ্জশিরে গত ৪ দিনের যুদ্ধে ৭০০ জন তালেবানকে হত্যার দাবি করেছে প্রদেশটির নেতা আহমাদ মাসুদ এবং আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ)। এছাড়া আরো প্রায় ৬০০ জনকে বন্দি করা হয়েছে বলে গতকাল রোববার এক টুইটবার্তায় জানিয়েছে জোট। এছাড়াও অধিকারের দাবিতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে নারীদের এক বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তালেবান।

টুইটে এনআরএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত পাঞ্জশিরে ৭০০ জনেরও বেশি তালেবান সদস্য নিহত হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে আরো ৬০০ জনকে। বাকিদের অনেকেই পালানোর চেষ্টা করছে। আমরা এগিয়ে আছি। সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। পুরো প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ এখনো আমাদের হাতে আছে।

আফগানিস্তনের মোট ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে এক পাঞ্জশির ছাড়া বাকি ৩৩ টিতেই দখল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তালেবান বাহিনী। দখলের বাইরে থাকা সর্বশেষ এই প্রদেশটি কব্জায় আনতে গত বৃহস্পতিবার থেকে পাঞ্জশিরে অভিযান শুরু করেছে তালেবান বাহিনী।
পাঞ্জশিরে ৭০০ তালেবান যোদ্ধা নিহত
রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম স্পুটনিককে এনআরএফ মুখপাত্র ফাহিম দাশতি জানিয়েছেন, পাঞ্জশিরের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় আটকাপড়া এই তালেবান সদস্যরা আশপাশের প্রদেশগুলো থেকে কোনো সহযোগিতা বা রসদপত্রের জোগান পাচ্ছেন না।

এছাড়া, পাঞ্জশিরের বিভিন্ন এলাকায় ল্যান্ডমাইন থাকার কারণে তালেবান বাহিনীর অগ্রযাত্রাও ধীরগতির হয়ে পড়েছে বলে স্পুটনিককে জানিয়েছেন তিনি। পাঞ্জশিরের বিভিন্ন এলাকায় ল্যান্ডমাইন থাকার কারণে তালেবান বাহিনীর অভিযান ধীরগতি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এক তালেবান মুখপাত্রও। আল জাজিরাকে ওই মুখপাত্র বলেন, পাঞ্জশিরের রাজধানী বাজারাক ও প্রাদেশিক গভর্নরের কার্যালয় এলাকা ল্যান্ডমাইন থাকার কারণে অভিযানে গতি আনা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে যে প্রদেশগুলো আয়তনে ছোট, পাঞ্জশির তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এই ক্ষুদ্রাকৃতির পার্বত্য প্রদেশটি কখনো পরাজিত হয়েছে-এমন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। গত শতকের আশির দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অভিযান চালানোর সময় পাঞ্জশির স্বাধীন ছিল। পরে তালেবান বাহিনী ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সরকার গঠন করলেও দখলে আনতে পারেনি পাঞ্জশিরকে।

এদিকে, তালেবানের মুখপাত্র বেলাল কারিমী এক টুইট বার্তায় বলেন, তালেবান যোদ্ধারা পাঞ্জশিরের রাজধানী বাজারাক সংলগ্ন রুখাহ জেলা কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে। এই তালেবান নেতা আরো বলেন, ব্যাপক সংখ্যক বিদ্রোহী যোদ্ধা হতাহত হয়েছে। অনেক সংখ্যক কারাবন্দিকে মুক্ত করা হয়েছে এবং সামরিক যান দখল করা হয়েছে।

তালেবানের অন্যতম মুখপাত্র বেলাল কারিমী বলেন, পাঞ্জশিরের রাজধানী বাজরাকে যুদ্ধ চলছে। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজধানী কাবুল থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের প্রদেশ পাঞ্জশিরে তালেবান এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে।

গতকাল রোববার তালেবান দাবি করেছে, তাদের যোদ্ধারা ৭টি জেলার মধ্যে ৫টি দখল করে নিয়েছেন। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা দাবি করছে, কয়েক শ’ তালেবান সদস্যকে তারা হত্যা করেছেন এবং তাদের হাতে বন্দি রয়েছে।

অপরদিকে, অধিকারের দাবিতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে নারীদের এক বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তালেবান। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা একটি সেতু থেকে হেঁটে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস এবং পিপার স্প্রে ছোঁড়া হয়। কাবুল ও হেরাতে নারীদের কয়েকটি বিক্ষোভের মধ্যে এটি সর্বশেষ সমাবেশ। নারীরা বাইরে কাজ করার অধিকার এবং সরকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়েছে এই বিক্ষোভে। তালেবান বলেছে, নারীরা আফগানিস্তানের নতুন সরকারে যোগ দিতে পারবে, কিন্তু মন্ত্রীর পদে থাকতে পারবে না। অনেক নারী ভয় পাচ্ছেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময়ে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল, সেই একই আচরণ আবারো করা হবে কিনা। নারীদের বাইরে বের হতে হলে মুখ ঢেকে রাখতে হতো এবং ছোটখাটো অপরাধের জন্যও কঠোর শাস্তি দেয়া হতো।

সাংবাদিক আজিতা নাজিমি আফগান টেলিভিশন টোলোকে বলেন, ২৫ বছর আগে, যখন তালেবান এসেছিল, তারা আমাকে স্কুলে যেতে বাধা দিয়েছিল। তাদের শাসনের পাঁচ বছর পর, আমি ২৫ বছর পড়াশোনা করেছি এবং কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমাদের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য হলেও আমরা এটি হতে দেব না।

অপরদিকে, ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তান দখলে নিয়েছে তালেবান। তবে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে তালেবানের কৌশল সম্পর্কে সবাই ভুল বুঝেছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ সামরিক প্রধান নিক কার্টার। তিনি বলেন, তাদের গতিই আমাদের অবাক করে দিয়েছিল এবং আমি মনে করি না যে তালেবান কী করতে যাচ্ছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি।

সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ভুল ছিল কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে। শুধু সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের ওপর সরকার নির্ভরশীল ছিল না বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গতকাল রোববার বিবিসিকে নিক কার্টার জানান, আমি মনে করি সবাই এই সহজ ব্যাপারে ভুল বুঝেছে। এমনকি তালেবানও আশা করেনি এত দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যাবে। তিনি আরো বলেন, আফগান সরকার যে কতটা নাজুক অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে কেউ অনুমান করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না। গত সপ্তাহেই আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সব ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনা। এর মধ্যদিয়ে দেশ হয়েছে দেশটিতে ২০ বছরের সংঘাতের। তবে পশ্চিমা বাহিনীকে এভাবে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়ার সমালোচনা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি তালেবান যে গতিতে আফগানিস্তান দখল করেছে তা নিয়েও সমালোচনা চলছে।

এই সপ্তাহের শুরুতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডোমিনিক রাব সংসদ সদস্যদের বলেছিলেন, গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল আগস্টে নিরাপত্তা পরিস্থিতির স্থিতিশীল অবনতি হবে, কিন্তু এই বছর কাবুল পতনের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেসব ধারণা ভুল প্রমাণ করে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে কাবুলের পতন হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লং ওয়ার জার্নালের (সাময়িকী) সম্পাদক বিল রোজিও বলেন, পাঞ্জশিরে তালেবান ও বিদ্রোহীদের সক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। উভয়পক্ষ প্রতিপক্ষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার দাবি করছে, যদিও নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য কেউ দিতে পারছে না।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার এবং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর পতনের পর তালেবান ব্যাপক পরিমাণে অস্ত্র পেয়েছে। গত ২০ বছর ধরে যুদ্ধের মাধ্যমে তালেবান যোদ্ধারা ‘স্পাতকঠিন’ রূপ ধারণ করেছে এবং ভুল করার কোনো উদাহরণ তাদের নেই। মার্কিন যুদ্ধবিষয়ক জার্নালের সম্পাদক বিল রোজারিও এসব কথা বলার অর্থ-পাঞ্জশিরে যুদ্ধে অবশ্যই তালেবান এগিয়ে থাকবে। তবে পাঞ্জশিরের বাইরে অবস্থান করা জাতীয় প্রতিরক্ষা ফ্রন্টের (এনআরএফ) মুখপাত্র আলী মাইসাম নাজরি বলছেন, প্রতিরোধ যোদ্ধারা (এনআরএফ) তালেবানের কাছে হার মানবে না। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে আফগানিস্তানে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলি। স্থানীয় সময় শনিবার মার্কিন এক গণমাধ্যমকে তিনি এমন ইঙ্গিত দেন। কাবুল পতনের মধ্যদিয়ে আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে এলেও সংঘাত থামেনি। দেশটির পাঞ্জশির প্রদেশে বিরোধীদের সঙ্গে তালেবানের তীব্র লড়াই চলছে। সেখানে সাত শতাধিক নিহত এবং সহস্রাধিক আহতের দাবি করেছে তালেবান ও বিরোধীরা। পাশাপাশি ভেঙে পড়তে চলেছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি।

দেশটির ব্যাংকগুলো এখন প্রায় অর্থশূন্য। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক সহায়তাও। এর মধ্যে কাবুল, হেরাতসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকার আদায়ের দাবিতে নেমেছেন আফগান নারীরা। এসব বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে তালেবানের হামলা চালানোর ঘটনাও ঘটেছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে শনিবার মার্ক মিলি বলেন, আফগান পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছে।’ গৃহযুদ্ধের জের ধরে আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আগামী ১-৩ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান হতে পারে।

গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ইরান সফরে যান এবং প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের সঙ্গে আফগানিস্তান ইস্যুতে কথা বলেন। আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছে তালেবান। এমন পরিস্থিতে বৈঠকে বসছেন ইরান, রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আফগান ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে।

খবরে বলা হয়, শনিবার ইরান, রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে টেলিফোন আলাপে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর তারা ভার্চুয়াল বৈঠকে বসার ব্যাপারে একমত হন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহিয়ান সমপ্রতি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। এ সময় তাদের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠনের বিষয় নিয়ে কথা হয় বলে জানা গেছে।

এর আগে, গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ইরান সফরে যান এবং প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের সঙ্গে আফগানিস্তান ইস্যুতে কথা বলেন।

এদিকে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থ আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল ফাইজ হামিদ শনিবার আফগানিস্তান সফরে গেছেন। তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর জেনারেল হামিদ হচ্ছেন আফগানিস্তান সফরকারী সবচেয়ে পদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তা। তালেবানের আমন্ত্রণে এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সফরকালে আইএসআই প্রধান তার তালেবানি সমকক্ষ নাজিবুল্লাহসহ সংগঠনটির অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে কথা রয়েছে। জেনারেল ফাইজ হামিদের কাবুল সফর সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি আর কোনো তথ্য প্রচার করা হয়নি এবং তালেবানের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post