বিএম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো- : খুলনাসহ বাগেরহাটের রামপালে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের ছড়াছড়ি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, বাড়ছে তাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য।
রামপাল উপজেলার ইসলামাবাদ বাজারে যেয়ে মোঃ নুরুল ইসলাম এর ছেলে মোঃ খলিলুর রহমান এর কাছে তার ডাক্তারি করার জন্য প্রয়োজনীয় ডিগ্রী সহ কাগজপত্র সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন সার্টিফিকেট নিয়ে ডাক্তারি করতে হয় এটা আমার জানা ছিল না। যেহেতু আমি কম্পাউন্ডার হিসাবে অনেক দিন কাজ করেছি তাই আমার ওস্তাদ এর নামে সাইনবোর্ড দিয়ে ডাক্তারি শুরু করেছি।
বর্তমানে তিনি সরাপপুর ফাজিল মাদ্রাসায় (লেকচারার আরাবিক) হিসেবে কর্মরত আছেন। একই উজেলার মা ক্লিনিক এর সত্বাধিকারী জয়দেব তিনিও নিজে ডাক্তার সেজে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা করে আসছেন।
এছাড়াও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আইটেমের বাহারি ডিগ্রি ব্যবহার করে চকচকে সাইন বোর্ড সাঁটিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করে আসছেন কিছু ভুয়া ডাক্তার । ফলে চিকিৎসাসেবায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে, ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় রোগীর পরিস্থিতি জটিল হয়েছে, অল্প সময়েই নিভে গেছে অনেকের জীবন প্রদীপ। বছরের পর বছর ধরে ভুয়া ডাক্তার কেন্দ্রিক নানা অরাজকতায় দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সরকারের দায়িত্বশীল বিএমডিসি, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমএ সহ ডাক্তারদের পেশাদার সংগঠনগুলো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ভুয়া ডাক্তারদের নানা দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা অজ্ঞাত কারণে ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। জাল সনদ এবং নবায়নহীন লাইসেন্সকে পুঁজি করেই ভুয়ারা জেলা ও উপজেলা সদরে অভিজাত চেম্বার সাজিয়ে অহরহ রোগীদের প্রতারণা করে চলছে। ভুয়াদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার নজির নেই বললেই চলে। জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে রুটিন অভিযান চালানো থেকেও বিরত থাকছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
ডাক্তারের পাশাপাশি জাল ডিগ্রিধারী ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের’ সংখ্যাও কম নয়। তারা এমবিবিএস ডিগ্রির আগে পিছে দেশ-বিদেশের ভুয়া, নকল,মনগড়া উচ্চতর সব ডিগ্রি ব্যবহার করে বছরের পর বছর রোগী দেখছেন, হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের ফি। ভুয়া ডাক্তার-দালালদের দৌরাত্ম্য, ভুল চিকিৎসা,অবহেলা আর চিকিৎসা বাণিজ্যের নির্মমতায় একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছে। ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের কথা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সবাই জানেন, কিন্তু তাদের দৌরাত্ম্য রোধকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা নেন না কেউ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চিকিৎসা সেক্টরে ভুয়া ডাক্তার ও অপচিকিৎসা ব্যবস্থাটি বছরের পর বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতোই চেপে আছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে বিএমডিসিকে ঢেলে সাজানোসহ শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। ভুয়া ডাক্তাররা প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে এবং কৌশলে সহজ সরল মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে থাকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভুয়া ডাক্তাররা নামের পেছনে এফআরএসএইচ, এমএসিপি, এফএসিপি, পিজিটি, এমডি ও এফসিপিএস (ইনকোর্স) ও পার্ট-১ অথবা পার্ট-২সহ বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করে থাকে। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামও উল্লেখ করা হয়। এ কারণে সাধারণ রোগীরা এসব ডাক্তারকে বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে মনে করেন। এত এত ডিগ্রি দেখে সরল মনে ভুয়া ডাক্তারদের দেখানোর জন্য ভিড় জমায়। এ সুযোগে ভুয়া ডাক্তাররা রোগীপ্রতি ফি নেন ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভুয়ারা চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে নিজেদের এমন সব পদ-পদবির পরিচয় ব্যবহার করেন, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। একইভাবে বিএমডিসি আইনে অনুমোদন করে না এ রকম পদ-পদবি ও ডিগ্রির ব্যবহারও করছেন। টাকায় বিক্রি হচ্ছে সার্টিফিকেট। এভাবে ভুয়া সনদ দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। চিকিৎসাসেবার নামে দেশজুড়ে ১৪ হাজার ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তার ছড়িয়ে পড়েছে। যারা অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে অবৈধ পতিষ্ঠানের লাইসেন্সকে পুঁজি করেই চিকিৎসা বাণিজ্যে নেমে পড়েছেন। চিকিৎসকদের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিএমডিসি। কিন্তু বিএমডিসিকে অনুকরণ করে বিসিএমডিসি নাম দিয়ে ভুয়া লাইসেন্সের কারবার চালাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
তাই অতি দ্রুত এইসকল ভুয়া ডাক্তারদের আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জোরদাবী জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বলেছেন, অন্যায় ও অবৈধভাবে কেউ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অতিসত্বর ভূয়া ডাক্তার ধরতে অভিযান পরিচালনা করে তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খুলনা জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, ভুয়া চিকিৎসকদের ধরতে উপজেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের অফিসের পক্ষ থেকে অভিযান শুরু হবে। এমবিবিএস ও বিডিএস পাশ করা চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবে না। বর্তমানে যারা পল্লী চিকিৎসক রয়েছেন, তাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা সরকারি সার্টিফিকেট নেই, তারাও ভুয়া চিকিৎসক। আবার অনেকে আছেন, ফার্মেসি খুলে লাইসেন্সবিহীন ডাক্তার সেজেছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।