গ্রেফতার হচ্ছে না মাদক গডফাদাররা

স্টাফ রিপোর্টার :রাজধানীসহ সারাদেশে মাদক বিরোধী অভিযানে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী গ্রেফতার হলেও মাদক গডফাদাররা গ্রেফতার হচ্ছে না।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও অধিকাংশ গডফাদার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দিন দিন ইয়াবা সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ইয়াবা পাচার করে আয় করা বিপুল টাকা বিদেশে পাচার করছে ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত গডফাদাররা। ইয়াবার উৎসভূমি হিসেবে পরিচিত মায়ানমার। আর বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট কঙ্বাজার। সারাদেশের ইয়াবার ৮০ ভাগ সরবরাহ হয় টেকনাথ থেকে। নেশার ভয়ানক ছোবল ক্রেজি ড্রাগ হিসেবে পরিচিত ছোট্ট আকারের এই ট্যাবলেট ব্যবসায় শুধুমাত্র কঙ্বাজারেই ১১৫১ জন জড়িত। এদের মধ্যে ৬০ জন গডফাদার। ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ইয়াবাসহ মাদকের গডফাদার ও ব্যবসায়ীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ৪টি সংস্থা মাদক পাচার ও ব্যবসার সাথে জড়িতদের তালিকা আপডেটের কাজ করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি মাসে মাদকের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ সদরদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুস্পষ্টভাবে বলেন, কঙ্বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সারাদেশের ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। গডফাদারের মাধ্যমেই দেশে আসে ইয়াবা। এই গডফাদারের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলারের মাধ্যমে পেমেন্ট মায়ানমারে পাঠানো হয়। গডফাদারের তালিকায় জনপ্রতিনিধিও রয়েছে। কঙ্বাজার থেকে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলে পিরোজপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঢাকা, খুলনার মংলা বন্দর, নোয়াখালী যায় ইয়াবা। এছাড়া স্থল পথেও ইয়াবা দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

কঙ্বাজারে মোট ৮টি থানার মধ্যে টেকনাফে ৯১২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আছে। এছাড়া কঙ্বাজার সদর থানায় ৪৩ জন, রামুতে ৩৪ জন, কুতুবদিয়ায় ৪৮ জন, উখিয়ায় ৭ জন, মহেশখালীতে ৩০ জন এবং পেকুয়ায় ২২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন। মূলত টেকনাফে পরিবারকেন্দ্রিকভাবে ইয়াবা ব্যবসা চলছে। মা-বাবা, স্ত্রীসহ অনেক পরিবারের প্রায় সবাই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। এদিকে মাদক ব্যবসায় জড়িত অধিকাংশের নামে ১০/১৫টি মামলা রয়েছে। কিন্তু ৬৫ ভাগ আসামি জামিনে থেকে দেদারছে ইয়াবা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। বাকিদের মধ্যে কেউ পলাতক আবার কেউ গ্রেফতার হননি।

প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, এর আগেও আমরা অভিযান চালিয়েছি? তবে তারা বাড়ি থাকে না তাই আটক করতে পারিনি ? এখন তারা বাড়িতে তালা মেরে পালিয়েছে? তাদের বাড়িগুলো রাজপ্রাসাদের মতো? তিনি বলেন, ঐ দুটি এলাকা সীমান্তবর্তী ? তাই মাদক ও ইয়াবা পাচারের বড় রুট ? আপাতত ঐ রুট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি? আর বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক ও ইয়াবা উদ্ধার করেছি?’

দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে যারা মাদক ব্যবসায়ী বলে পরিচিত, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে? যাদের আটক করা হচ্ছে, তারা মাদকসেবী ও সাধারণ খুচরা বিক্রেতা?

যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা মূল পাচারকারী তারা গ্রেফতার হচ্ছেন না ? তাদের কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে, আবার কেউ রাজনৈকিতভাবে প্রভাশালী হওয়ায় এলাকাতেই আছেন। আর মাদক আইনের ফাঁকের কারণে তাদের ধরাও যাচ্ছে না বলে পুলিশ জানায়। মাদক ব্যবসার সাথে কোনো কোনো এলাকার পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশ থাকায় অভিযান দেখানোর জন্য সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে অনেক।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একাধিকবার বলেছেন, গডফাদারসহ কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। হয়রানি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে ? কিন্তু তার এই ঘোষণার মধ্যেই টেকনাফের মাদকের গডফাদার বলে পরিচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান বদি তার দুই সহযোগীকে নিয়ে সৌদি আরবে ওমরাহ করতে চলে গেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হলো যে, বদির বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ আছে, তবে প্রমাণ নেই? বাংলাদেশে মাদকের সাথে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তাদের একাংশ মাদক চোরাচালান করেই এখন সিআইপি ব্যবসায়ী হয়েছেন।

এ রকম ১৪১ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকাও করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারা ধরা পড়ছেন না বা তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার তৎপরতা ছাড়াও আইনের ফাঁক ফোঁকর কাজ করছে বলে অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- থাকলেও কারোর দখলে বা অবস্থানে মাদক পাওয়া না গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়? যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা গডফাদার তারা মাদক পরিবহণ বা নিজেদের কাছে রাখেন না? ফলে তারা মূল অপরাধী হলেও পার পেয়ে যান। যারা খুচরা বিক্রয় করেন বা সেবন করেন তারাই ধরা পড়েন। আর আইনে মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা, পাচারকারী ও নিয়ন্ত্রক আলাদাভাবে নেই। ফলে যার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, তাকেই মামলায় আসামি করা হয়। বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে মোট ১১ হাজার ৬শ ১২টি? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর শাস্তি পেয়েছেন ১ হাজার ৬৫ জন? আর খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ৬শ ১৫ জন?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, মাদকসহ হাতেনাতে ধরতে না পারলে তাকে আইনের আওতায় আনা যায় না ? ফলে গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। কারণ তারাতো নিজেদের কাছে মাদকদ্রব্য রাখেন না? আমরা তাদের সম্পর্কে তথ্য পেলেও মাদক আইনে কিছু করতে পারি না। তবে মানিলন্ডারিং, দুর্নীতি দমন ও আয়কর আইনে গডফাদারদের ধরার সুযোগ আছে বলে জানান এই কর্মকর্তা ? তিনি বলেন, আমরা আটকদের জবানবন্দির ভিত্তিতে কিছু মামলা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছি মানি লন্ডারিং আইনে আনার জন্য?

২০১৪ সালে দুদক ইয়াবার গডফাদার বলে পরিচিত শাসক দলের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল? নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামার তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার পর বদির আয় বাড়ে ৩৫১ গুণ? আর নিট সম্পদ বাড়ে ১৯ গুণের বেশি? টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মায়ানমারের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও টেকনাফে জ্বালানি তেলের ব্যবসা করে ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছরে বদি ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০ টাকা আয় করেন বলে হলফনামায় জানান। এর আগে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেয়া হলফনামায় বদির বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা। আর ব্যয় ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ৭২৮ টাকা।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post