মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার ক্রসফায়ারে গতকাল নিহত হয়েছে ৬ জন

ক্রসফায়ারে

 

৭ দিনে নিহতের সংখ্যা ১৫ জন

স্টাফরিপোটার:  দেশে ঘোষণা দিয়ে মাদক বিরোধী অভিযানে গত সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে ৯ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। গতকাল রোববার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে ৬ জন নিহত হয়েছে। এই নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে ১৫ জন নিহত হয়েছে। র‌্যাব বা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসায়ী। মাদক বহনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তারা মারা গেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বিভিন্ন ‘ক্রসফায়ারের’ নিরপেক্ষ তদন্ত করতে বলছেন বহুদিন ধরে। তাদের ভাষ্য, যথাযথ আইনের মাধ্যমেই অপরাধীদের বিচার হতে হবে। ক্রসফায়ারে যারা নিহত হচ্ছে তারা ছোট ছোট মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ের গডফাদার, মূল হোতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শাস্তি ও আইনের আওতায় আনা এবং তাদেরকে নির্মূল করা জরুরি মনে করছেন সচেতন মহল।
জানা গেছে, ময়মনসিংহ, ফেনী, বরিশাল, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও যশোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার দিনগত রাত দুইটা থেকে গতকাল রোববার ভোর পর্যন্ত এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। নিহতরা মাদক ব্যবসা এবং চোরা কারবারির সাথে জড়িত বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নিহতরা হলেন, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পাঠান গড় গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে আলমগীর হোসেন ভূইয়া (৩৩), ময়মনসিংহ শহরের মাসকান্দা এলাকার রিয়াজুল ইসলাম বিপ্লব (৪০), বরিশালের সদর উপজেলার শায়েস্থাবাদ এলাকার অজ্ঞাত যুবক, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার টেঘরা নারায়ণগপুর গ্রামের মৃত আব্দুল ওহাবের ছেলে বাবু ওরফে গলাকাটা বাবু (৪৫), যশোরের অজ্ঞাত (৩৫) পরিচয়ের এক ব্যক্তি ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-বালিয়া-উয়ার্শী সড়কের পুষ্টকামুরী দক্ষিণপাড়া ব্রিজের কাছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি।

ফেনী প্রতিনিধি জানায়, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পশ্চিম পাঠান গড় এলাকায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আলমগীর হোসেন ভূইয়া নিহত হয়েছেন।

ছাগলনাইয়া থানার ওসি এম মোর্শেদ জানান, নিহত আলমগীর হোসেন ভূইয়া এলাকার চিহ্নিত মাদক চোরা কারবারি। তার বিরুদ্ধে ফেনী সদর, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া থানায় নয়টি মামলা রয়েছে। তিনি জানান, ছাগলনাইয়ার পশ্চিম পাঠান গড় এলাকায় মাদকের একটি বড় চালান যাওয়ার খবরে পুলিশের একটি দল রাতে সেখানে অভিযানে যায়। উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলি থামার পর সেখান থেকে আলমগীরকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ফেনী জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আলমগীরকে মৃত ঘোষণা করেন।

বন্দুকযুদ্ধে দেলোয়ার হোসেন ও মতিয়ার রহমান নামে পুলিশের দুই এএসআই আহত হয়েছেন। তাদের জেলা সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি বন্দুক, তিন রাউন্ড গুলি, এক হাজার ইয়াবা ও শতাধিক বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেছে বলেও জানান ওসি।

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানায়, ময়মনসিংহের মাসকান্দা এলাকার গনশার মোড়ে গত শনিবার দিনগত রাত দুইটার দিকে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে রিয়াজুল ইসলাম বিপ্লব নিহত হয়েছেন। ডিবি’র দাবি, বিপ্লব শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং চিহ্নিত চোরা কারবারি ছিলেন।

ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই পরিমল দাস জানান, মাসকান্দা এলাকায় কয়েকজন মাদক কারবারি একটি চালানের ভাগাভাগি করছে, খবর পেয়ে ডিবি’র একটি দল সেখানে অভিযানে যায়। উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পিছু হটলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিপ্লবকে আটক করে পুলিশ। পরে গুলিবিদ্ধ বিপ্লবকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বন্দুকযুদ্ধের সময় রাশেদুল ও কাওছার নামে দুই কনস্টেবল আহত হয়েছেন। পুলিশ হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গ্রাম হেরোইন, ২০০টি ইয়াবা, তিনটি গুলির খোসা ও দুটি চাকু উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান এসআই পরিমল।

বরিশাল প্রতিনিধি জানান, বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্থাবাদ এলাকায় ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে গত শনিবার দিনগত সাড়ে তিনটার দিকে অজ্ঞাত এক যুবক নিহত হয়েছেন।

বরিশাল মহানগর ডিবি’র সহকারী কমিশনার নাছির মলি্লক জানান, সমপ্রতি শায়েস্তাবাদে ডাকাতি বেড়ে গেছে। এজন্য গত শনিবার রাত আড়াইটার দিকে আইচা গ্রামে পুলিশের একটি দল টহল দিতে যায়। পথে কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে তাদের পরিচয় জানতে চায়। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পরে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি রামদা, একটি পাইপগান ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান নাছির মলি্লক।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানায়, জেলার বিরল উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বাবু ওরফে গলা বাবু (৪৫) নাকে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গত শনিবার দিনগত রাত দুইটার দিকে উপজেলার মুরাদপুরে এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। নিহত বাবু বিরল উপজেলার টেঘরা নারায়ণগপুর গ্রামের মৃত আব্দুল ওহাবের ছেলে। পুলিশের দাবি, নিহত বাবু চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তার নামে বিরল থানায় ৯টি মামলা রয়েছে।

বিরল থানার ওসি আব্দুল মজিদ জানান, রাতে মুরাদপুরে মাদক বিরোধী অভিযানে যায় পুলিশ। উপস্থিতি টের পেয়ে গলাকাটা বাবুর নেতৃত্বে মাদক কারবারিরা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে মাদক কারবারিরা পিছু হটে। পরে সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাবুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বন্দুকযুদ্ধের সময় পুলিশের দুই কনস্টেবল আহত হয়েছেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে একটি রাইফেল, একটি হাসুয়া, চাটির ককটেল ও ১৯৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে।

যশোর প্রতিনিধি জানায়, মাদক ব্যবসায়ীদের দু’পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে যশোরে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। গতকাল রোববার ভোরে যশোরের ছুটিপুর সড়কের রুদ্রপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ৪শ পিস ইয়াবা, ১টি ওয়ানশুটার গান, ১ রাউন্ড গুলি ও ৪টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।

মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানায়, গত শনিবার দিনগত রাত দুইটার দিকে মির্জাপুর-বালিয়া-উয়ার্শী সড়কের পুষ্টকামুরী দক্ষিণপাড়া ব্রিজের কাছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অজ্ঞাতপরিচয় এক ছিনতাইকারী নিহত হয়েছেন।

মির্জাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মিজানুল হক বলেন, টহলরত পুলিশ সদস্যার ঐ ব্রিজের কাছে গেলে ছিনতাইকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ঐ স্থানে তল্লাশি চালিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় এক ছিনতাইকারীকে উদ্ধার করে কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহততের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এছাড়াও মাদক বিরোধী অভিযানে গত শুক্রবার রাতে যশোরে বন্দুকযুদ্ধে ৩ জন, গত বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ্থে এক ব্যক্তি, গত সোমবার রাতে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় দুই ব্যক্তি, গত বুধবার রাজশাহীতে এক ব্যক্তি ও বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তি নিহত হন।

পুলিশ সদরদফতরের এক হিসেবে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে মাদক মামলা হয়েছে ৯৮ হাজার ৯৮৪টি। ২০১৬ সালে ১৮ হাজার ২৮৭টি, ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৫১২টি, ২০১৪ সালে ৪২ হাজার ১৯০টি, ২০১৩ সালে ২৯ হাজার ৩৪টি। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই মামলা বাড়ছে।

তবে ক্রসফায়ারে কি মাদক সমস্যার সমাধান সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, এভাবে সমাধান মিলবে না। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময়ই শর্ট-কার্ট পদ্ধতিতে সমাধান চায়। যেটা সম্ভব নয়। বরং একটা অপরাধ নির্মূল করতে গিয়ে আরেকটা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। ফলে মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমি মনে করি, আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। উৎসগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। এটা একটা পথ, যেটা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়। মাদক ব্যবসা যারা করে, তারা তো ভয়ঙ্কর লোক। সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি গোলাগুলিতে কেউ মারা যায়, সেটা ঠিক আছে। কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ৩ মে র‌্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই র‌্যাব মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করে। ১৮ মে পর্যন্ত দেড় হাজার মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। তবে মূল অভিযান শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার থেকে।

Post a Comment

Previous Post Next Post