'কমলপ্রভা' ভবনের ৫ম তলা ধ্বংসস্তূপে পরিণত

mirpur junge

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ী এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ৬ তলা বিশিষ্ট ‘কমলপ্রভা’ নামের বাড়িটির ৫ম তলা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ৫ম তলার ‘জঙ্গি আস্তানা’ থেকে ২ শিশুসন্তানসহ ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ এবং তার ২ স্ত্রী ও ২ সহযোগীর পুড়ে কয়লা হওয়া বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ গতকাল বুধবার বেলা ৩টা ১৮ মিনিটে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি আরও বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে পরপর ৩টি বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে প্রায় ৫শ মিটার বেগে বিস্ফোরক পদার্থগুলো চারদিকে ছিটকে পড়ে। এতে ভবনের ৫ম তলার জানালার থাই গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ৫ম তলার মেঝেতে ফাটল তৈরি হয়। ঐ ফাটল দিয়ে ৫ম তলার ‘জঙ্গি আস্তানায়’ রক্ষিত কেমিক্যাল চতুর্থ তলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পর ঐ কেমিক্যালে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঐ আগুনে ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহসহ তার ২ সহযোগী, ২ স্ত্রী ও ২ সন্তানও পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।

র‌্যাব ডিজি আরও বলেন, চোখে দেখে নিহতদের কাউকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ ২০০৫ সালে জঙ্গিবাদে (জেএমবি) সম্পৃক্ত হয়। ২০০৮-০৯ সালে জেএমবি ভেঙে তামিম-সারোয়ারের নেতৃত্বে নব্য জেএমবি গঠিত হয়। ঐ সময় ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। তার বাসায় (‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ) নব্য জেএমবি’র শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই সময় কাটিয়েছেন বলেও জানান র‌্যাব প্রধান। সে ফ্রিজ মেরামত ও আইপিএস তৈরির পেশার আড়ালে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলেছিল। আরও জানা গেছে, আব্দুল্লাহর বড় ভাই খোকার ছিল আইপিএস সরবরাহের ব্যবসা। তার পুরো নাম জানা সম্ভব হয়নি। অভিযান চলাকালে সে বাড়িটিতে ছিল কিনা তাও জানা যায়নি। তার ছিল দীর্ঘ বাবরি চুল। এছাড়াও আব্দুল্লাহর পেশা ছিল কবুতর বেচাকেনা। বাড়ির ভেতরেই সে বিরাট কবুতরের খামার গড়ে তুলেছিল। সে ছিল হালকা পাতলা গড়নের। তারা নামাজ পড়তো। ২ ভাইয়েরই দাড়ি ছিল।

জানা গেছে, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গত সোমবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে ঘিরে ফেলা হয় রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ী এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ৬ তলা বিশিষ্ট ঐ বাড়িটি। বাড়িটিতে ২ স্ত্রী, সন্তান ও সহযোগীসহ দুর্ধর্র্ষ জঙ্গি আব্দুল্লাহ অবস্থান করছিলেন। সেখানে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও মজুদ করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা আত্মঘাতী হন।

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহর বাবার নাম মৃত মীর ইউসূফ আলী, বাড়ি মেহেরপুরে। তার ২ স্ত্রী-নাসরিন ও ফাতেমা, ২ সন্তান-ওসমান (৯-১১) ও ওমর (৩)। ঐ বাসায় আব্দুল্লাহর বোন মেরিনাও অবস্থান করছিলেন। তিনি গত সোমবার গভীর রাতে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তীতে মেরিনার মাধ্যমে র‌্যাবের সঙ্গে আব্দুল্লাহর যোগাযোগ স্থাপন হয়। আব্দুল্লাহর আরেক ভাই (৪৫) রয়েছে, তবে তার নাম জানা যায়নি। তিনি কোরআনে হাফেজ বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে মুফতি মাহমুদ খান সংবাদকর্মীদের জানান, জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ না করে রাত পৌনে ১০টার দিকে পরপর বড় ৪টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে র‌্যাবের ৪ সদস্য স্পিস্নন্টারের আঘাতে আহত হন। বিস্ফোরণের কারণে ঐ ভবনে আগুন লেগে যায়। গতকাল বুধবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঐ বাড়ির ধ্বংসস্তূপে তল্লাশি অভিযান শুরু করে র‌্যাব সদস্যরা।

এর আগে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মুফতি মাহমুদ খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ তার সহযোগীদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তারা ধ্বংসাত্মক কিছু করতে পারে কিনা-সেই বিষয়ে র‌্যাবের কড়া নজরদারি রয়েছে। র‌্যাবও সতর্কাবস্থায় আছে।

এর আগে বাড়িটির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এছাড়া টেলিফোন, ডিস ও ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। মানসিকভাবে চাপে ফেলতে এবং তারা (জঙ্গিরা) যাতে বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে-এ কারণে এসব করা হয়েছে বলেও র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

এরও আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বলেন, আব্দুল্লাহ দুর্ধর্র্ষ জঙ্গি। তার সঙ্গে আমাদের রাত ৪টা থেকে যোগাযোগ হচ্ছে। তাকে আমরা বিভিন্নভাবে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানাই। তিনি আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছুটা সময় চেয়েছেন। বেনজীর বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছি। এরপরও তিনি যদি আত্মসমর্পণ না করেন এবং র‌্যাবের ওপর হামলার চেষ্টা করেন তাহলে আমরা আইনি পদ্ধতিতে অভিযানে যাবো। বাড়িটিতে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। তবে এরই মধ্যে নারী ও শিশুসহ সব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ভেতরে কী পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে জানতে চাইলে র‌্যাব প্রধান বলেন, আমাদের তথ্যমতে ভেতরে ৫০টিরও বেশি দেশীয় তৈরি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি বোমা) রয়েছে। এছাড়া এসিডসহ বিস্ফোরক তৈরির বিভিন্ন দ্রব্যাদি তার কাছে মজুদ আছে। ছোট ১টা পিস্তল আছে বলেও আমরা ধারণা করছি।

টাঙ্গাইলের ১টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র‌্যাব। ঐ আস্তানা থেকে জেএমবি’র ২ জঙ্গিকে আটক করা হয়। পরে তাদের তথ্য অনুযায়ী রাত ১টায় অভিযান চালিয়ে মাজার রোডের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের দক্ষিণে বর্ধনবাড়ী এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ২/৩/বি নম্বর বাড়ির ৫ম তলায় জঙ্গি আস্তানাটি খুঁজে পায় র‌্যাব।

অপরদিকে ‘জঙ্গি’ আস্তানা সন্দেহে রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ী এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ৬ তলা বিশিষ্ট ‘কমলপ্রভা’ নামের বাড়িটি গত সোমবার মধ্যরাত থেকে ঘেরাও করে রাখে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। এরপর গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বাড়িটির ভাড়াটিয়াদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। মঙ্গলবার সারাদিন-রাত আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় তাদের সময় কাটে। গতকাল বুধবারও তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়। অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আশ্রয় এখন দারুসসালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যাচাই-বাছাই শেষে অনেককে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হেফাজতে ছেড়ে দেয়া হয়। রাজধানীতে যাদের কোনো স্বজন নেই তাদের দারুসসালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে গত মঙ্গলবার সকাল থেকে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।

এছাড়া ‘কমলপ্রভা’ বাড়িটির আশপাশের বাসিন্দাদেরও চরম বিপাকের মধ্যে সময় পার করতে হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদেরও দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। যারা বাসার বাইরে ছিলেন তারা আর বাসায় ফিরতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে রাতে তাদের বাইরে থাকা ও খাওয়া-দাওয়া করতে হয়।

২/৩/বি ‘কমলপ্রভা’ বাড়িটির এক ভাড়াটিয়া জানান, জঙ্গি আস্তানায় অভিযান ও নিরাপত্তার স্বার্থে গত মঙ্গলবার সকালে তাদের বাসা থেকে বের করে আনা হয়। পাশের দারুসসালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়। রাত পার হয়ে ভোর হলেও এখনও অভিযান শেষ হয়নি। দারুসসালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে খাবার ও পানির সঙ্কট থাকায় বাধ্য হয়ে গতকাল বুধবার সকালে পুরান ঢাকার এক আত্মীয়ের বাসায় পরিবারের বাকি সদস্যদের দিয়ে আসেন।

র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, মিরপুরের মাজার রোডের জঙ্গি আস্তানার ঐ বাড়িটির ২৩টি ফ্ল্যাট থেকে মোট ৬৫ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৬ জন পুরুষ, ২৪ নারী ও ১৫ শিশু রয়েছে।

প্রসঙ্গত, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গত সোমবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে ঘিরে ফেলা হয় রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ী এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ৬ তলা বিশিষ্ট ঐ বাড়িটি। বাড়িটিতে ২ স্ত্রী, সন্তান ও সহযোগীসহ দুর্ধর্র্ষ জঙ্গি আব্দুল্লাহ অবস্থান করছিলেন। সেখানে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও মজুদ করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা আত্মঘাতী হন।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post