গরুর ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

DSC0258-620x330

কোরবানির পশুর দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা পুলিশের নির্যাতনের শিকার ট্রাকচালকসহ গরু ব্যবসায়ীরা

হাবিবুর রহমান : কোরবানির পশুকে ঘিরে পথে পথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। ধীরে ধীরে রাজধানীতে বাড়ছে পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদাবাজিও। বিভিন্ন মহাসড়কে পথে-ঘাটে এমনকি গরুর হাটগুলোতে চাঁদাবাজরা বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি করছে। প্রসাশনের যোগসাজশে ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন চাঁদাবাজিতে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিতে পাইকাররা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে কোরবানির পশুর দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কোথাও কোথাও পরিবহণ শ্রমিক, কোথাও ক্ষমতাসীন দল, কোথাও বা পুলিশের নামে তোলা হচ্ছে টাকা। এছাড়া সীমান্তের ঘাটগুলোতেও বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে বরাবরের মতোই বেপরোয়া হয়ে পড়েছে চাঁদাবাজরা। কোরবানির পশু রাজধানীতে আসা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য।

ক্ষমতাসীন দলের লোকরা চাঁদাবাজি করছেন বিভিন্ন পরিবহণ সমিতির ও সংগঠনের নামে। অন্যদিকে পুলিশ গাড়ির কাগজপত্র দেখার নাম করে চাঁদা তুলছে। সরকারের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি রোধের জন্য সাদা পোশাকে পুলিশি টহলের কথা বললেও কার্যত কোনো উপকারে আসছে না। কারণ সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরাও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গরুভর্তি ট্রাক আসার পথে সারাংপুর পুলিশ পাড়ায় ট্রাক দাঁড় করায় বিজিবি’র ২ সদস্য। শ্রমিকরা জানান, এখানে ১শ টাকা দিতে হয়। তবে সাংবাদিকদের কাছে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেন বিজিবি’র ১ সদস্য। চেকপোস্ট না থাকার পরও কেন ট্রাক দাঁড় করালো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ট্রাকে অবৈধ মালামাল আসছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে। কিছু দূর পর রাজাবাড়ী বিজিবি ক্যাম্পে দেখা গেল প্রতিটি গাড়ি কাগজ পরীক্ষা করছেন বিজিবি ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। এখানেও ২শ টাকা নেয়ার অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখানেও টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেন তারা। এ বিষয়ে বিজিবি ক্যাম্পে কথা বললে তারা কোনো মতামত দেয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ট্রাক মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ২শ টাকা করে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ টার্মিনালে ৫০, কাসিয়াডাঙ্গা মোড়ে ১শ, ঝলমলিয়ায় ৫০, নাটর গোল চত্বরে ৫০, টাঙ্গাইলে ৫০ ও গাজীপুরে ১শ টাকা নেয়ারও অভিযোগ করেন ট্রাক চালকরা। চাঁদা আদায়ে পিছিয়ে নেই পুলিশও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত অন্তত ১০টি স্থানে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশ্বরোড ও সিসিটিভির মোড়ে ৩শ টাকা, গোদাগাড়ী পুলিশ ফাঁড়িতে ৩শ টাকা। রাজশাহীর কাসিয়াডাঙ্গা থেকে বেলকুচি পর্যন্ত ৫টি স্থানে কয়েকশ টাকা। নাটোর হাইওয়ে রোডের অন্তত কয়েকটি স্থানে কয়েকশ টাকা। পাটেশ্বরে ১শ টাকা, নাটোর হাইওয়ে রোডে অন্তত ৩টি স্থানে ৩শ থেকে ৫শ টাকা, নাটোর পুলিশ ফাঁড়িতে ৫শ টাকা করে নেয়ার অভিযোগ করেছেন ড্রাইভার ও ব্যবসায়ীরা।

এদিকে নাটোরের বনগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ট্রাকচালকরা জানান, পুলিশ সার্জেন্ট রুহুল আমিন ১ ট্রাকচালকের কাছে ২ হাজার টাকা দাবি করেন। ঐ চালক ৭শ টাকা দিলেও সন্তুষ্ট হননি তিনি। পরে ড্রাইভারকে নামিয়ে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। হাসপাতালে ড্রাইভার মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, চাঁদা না দেয়ায় রুহুল আমিন গাড়ির ওপর থেকে মারতে মারতে ড্রাইভারকে নিচে নামিয়ে আনেন। লুঙ্গি খুলে গেছে, তারপরও সেই অবস্থায় মেরেছে তাকে। চাঁদা না দিলে এমন ঘটনা মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। তবে উত্তেজিত জনতা পুলিশ সার্জেন্ট রুহুল আমিনকে ১টি ঘরে আটকে রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ বিষয়ে পুলিশ সার্জেন্ট ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম। কোরবানির পশুর গাড়ি যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে সেই ব্যবস্থার কথাও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

সূত্র আরও জানায়, উত্তরবঙ্গ থেকে পশু রাজধানীতে আসার সময় পাইকাররা প্রথম চাঁদাবাজির শিকার হন বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে। কমপক্ষে ১০-১২টি স্থানে তাদের চাঁদা দিতে হয়। পুলিশ, স্থানীয় সন্ত্রাসী, সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশ-র‌্যাবের সোর্সরা এসব টাকা আদায় করছেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর দু’পাড়ে পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের ট্রাকপ্রতি ৩শ টাকা, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় ৩শ টাকা, সাভার, আশুলিয়া ও আমিনবাজারে ২শ-৩শ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ট্রাকচালকরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশবেশে কয়েকটি পয়েন্টে কাগজপত্র দেখার নাম করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা না দিলে ট্রাক আটকে রাখা হয়। জামাল নামে ১ ট্রাকচালক অভিযোগ করেন, মাওয়া বা আরিচা ঘাটে ফেরির সিরিয়াল পেতেই চাঁদা দিতে হয় ৪শ-৫শ টাকা। দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতে আড়িয়াল খাঁ, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নিমতলী, হাসারা, কালীগঞ্জ নতুন রাস্তা ও পদ্মার দু’পাড়ে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীতে প্রবেশের সময় বাবুবাজার, পোস্তগোলা ও সাভারে টোকেনের নামে চলছে চাঁদাবাজি। উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রাক ঢাকায় প্রবেশের সময় গাজীপুর চৌরাস্তা, বাইপাইল, আশুলিয়ায় হাইওয়ে পুলিশ ও সার্জেন্টদের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন পাইকাররা। তাছাড়া সরকার দলীয় চাঁদাবাজরা তো রয়েছেই।

একাধিক গরু ব্যবসায়ী জানান, ভারতীয় গরু আনতে সীমান্তের ওপারে বিএসএফকে দিতে হয় মোটা অংকের ‘পাসিং খরচ’। সেখান থেকেই শুরু। এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে গরু আনার পর সরকার নির্ধারিত রাজস্বের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এরপর গরুর ট্রাক রাজধানীতে নিয়ে আসতে পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। রাজশাহী-চাঁপাই সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৬টি স্পটে, সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে যশোর পর্যন্ত ২টি ও যশোর সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৩টি স্পটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। রাজশাহীতে পুলিশ ও মোটর শ্রমিক নামধারীরা বিভিন্ন স্পটে ২৫০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গরুর ট্রাক থেকে পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৭শ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে তারা। সাতক্ষীরা সীমান্তে বিএসএফকে ‘পাসিং খরচ’ হিসেবে দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। যশোর সীমান্ত থেকে ঢাকার গাবতলীতে গরু নিয়ে আসতে বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকপ্রতি ৩শ-৫শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ডিএমপি’র কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেন, পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চাঁদাবাজদের ধরতে সাদা পোশাকের পুলিশ রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে টহল দিচ্ছে। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও রয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। অপরদিকে চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা- রোধ করতে গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশ-র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও থেমে নেই চাঁদাবাজি।

 

 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post