বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: উপকুলীয়ঞ্চল খ্যাত সুন্দরবনের মোহনায় অবসি’ত বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে মাছের বাজারে আগুন। কাড়ি কাড়ি টাকা হলে শহর বন্দরে মাছ পাওয়া যায়। কিন’ গ্রামে গঞ্জে তাও নেই। পল্লীতে এখন আর পুকুর ভরা মাছ নেই। “মাছে ভাতে বাঙ্গালী” এ প্রবাদটি এখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎসখনি খ্যাত খুলনাঞ্চলে ৫৫ প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অসি-ত্ব বিলীন হতে চলেছে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। বাজারে যদি বিদেশী ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে আমিষের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর ছিলোনা। শহর বন্দর গ্রামে গঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সংকট। যা পাওয়া যায় তার অগ্নিমূল্য। বিগত দিনে সরকারের উদাসীনতা, মৎস্য অধিদপ্তরের বাস-বসম্মত সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহনের অভাব এবং যে সকল প্রকল্প ও কর্মকান্ড হাতে নেয়া হয়েছিল তার যথাযত বাস-বায়ন না করায় এ সেক্টরটি “শিকেয়” উঠেছে। অতিব গুরুত্বপূর্ন এবং অত্যাবাশকীয় সম্ভবনাময় এ খাতটি এখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মৎস্য অধিদপ্তর এবং কয়েকটি এনজিও এসব বিষয়ে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে তাও যৎ সামান্য । তাছাড়া যে সকল প্রচলিত আইন ও ধারা রয়েছে তার বাস-বায়ন হচ্ছেনা। জন সচেতনতা তৈরীতে দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসছে না।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে কয়েক দশক পুর্বেও এ অঞ্চলে আড়াইশত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন’ মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অসি-ত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কালের গর্ভে মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
মৎস অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দুই দশক পূর্বেও খুলনার রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, কয়রা ও ফুলতলা এবং খুলনা সন্নিকটস’ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াইশ’ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাশপাতা, ভাঙ্গান, কাইন, খল্লা, দেশী পুটি, গোদা চিংড়িসহ ৫৫ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদে ও পুষ্টি গুনে ছিল ভরপুর। এ অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জের কয়েকশ’ হাওড় বাওড়, বিল, খাল নদী থেকে এসকল মাছ সংগ্রহ করতো জেলে সমপ্রদায়। সারা বছর তারা মৎস শিকার করে নিজ পরিবারের চাহিদাপূরণ সহ জীবিকা নির্বাহ করত। শুষ্ক মৌসুমে খাল বিল হাওরের পানি কমে গেলে চলত মাছ ধরার উৎসব। দেশের দূর দূরানে-র বাজার সমূহে খুলনা থেকে বিপুল পরিমান মাছ সরবরাহ করা হত। কিন’ এখন খুলনাঞ্চলে চট্রগ্রাম কক্সবাজার থেকে মাছ এনে চাহিদা পূরন করা হয়। সামুদ্রিক মাছ আসছে দেদারসে । বিকল্প হিসাবে শুটকি মাছেরও প্রচুর ব্যবহার হচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমের পুর্বে এপ্রিল মাস থেকে খালে বিল নদীতে মাছ ডিম্ব নিঃস্বরন শুরু করে। কারেন্ট জালের ব্যাপকতায় খাল, বিল নদীতে এ মাছের রেনু ধরা পড়ে মাছের প্রজনন প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস- হচ্ছে। জালে ধরা পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার রেনু মাছ। পরিবেশ ও মৎস বিজ্ঞানীদের মতে খুলনাঞ্চলে মৎস প্রজাতি বিলুপ্তির কারন হচ্ছে, অপরিকল্পিততভাবে জলাধারে বাধ দেয়ায় ভরা বর্ষা মৌসুমে ডিম ছাড়ার মা মাছ আসতে বাঁধা পায়। মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাঁধা তদুপরি খাল, বিল, হাওড়, বাওড়গুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসার কারণে মাছের বংশ বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে পানি দুষণ জলাশয়ের গভীররা হ্রাস, ছোট মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহারের কারণেও মাছে প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে। মারাত্মক পানি দূষনের কারনে আজ খুলনার ময়ূর নদী মাছের বংশ বৃদ্ধি ও জীবন ধারনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য বাধ দিয়ে লোনা পানির আধার নির্মানের কারনে অনেক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফসলের ক্ষেতে মাত্রারিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাছে বিলুপ্তি ঘটছে।
খুলনার কয়েকজন প্রবীন ব্যাক্তি জানিয়েছেন, এক সময় জেলার তেরখাদা উপজেলার চিত্রা নদীতে ২ কেজি ওজনের ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। ভৈরবে পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ। এমন কোন মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের বিল ডাকাতিয়া অথবা নলামারা, বাইশোর বিলে পাওয়া যেতনা। নলামারা বিলে ১২ কেজি ওজনের কালিবাউশ মাছ তারা জাল দিয়ে ধরেছেন পর্যন-। বাইল্লা, ডগরা, কাজলি, ভাঙ্গান, ভোলা প্রভৃতি মাছ তারা খাওয়ার অযোগ্য মনে করে ধরার পর ফেলে দিতেন। এখন এগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে মনে হবে কল্প কাহিনী। দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে মৎস্যজীবী তথা সর্বসাধারণকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি স’ানীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন ও মৎস্য সংরক্ষণ আইনের সঠিক বাস-বায়ন নিশ্চিত করণের মাধ্যমেই সম্ভব।
বি এম রাকিব হাসান,
খুলনা ব্যুরো