বি.এম.রাকিব হাসান, খুলনা: উপকুলীয় অঞ্চলের চিংড়ি, পাট ও কাকড়া শিল্পের পর এখন সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। তৃনমূল পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রসার লাভ এবং শিল্প বিকাশে পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে অত্যান- গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় রয়েছে। এককালের কুঠির শিল্পের মত পোল্ট্রি শিল্প এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে বিস-ৃতি লাভ করায় তা এখন অমিত সম্ভাবনার নতুন হাতছানি। তবে চতুর্মূখি সংকটের বেড়া জাল থেকে বের হতে চাইছে খুলনাঞ্চালের পোল্ট্রি শিল্প। এ শিল্পে রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার তথা দেশোন্নয়নে এক বিশাল ভূমিকা। দারিদ্র বিমোচনে উদীয়মান এ শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং সুষ্ট নীতিমালা ও নানা সংকটে গত ৬ মাসে নতুন করে প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার ক্ষুদ্র চাষি তাদের খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। গত বছরের সংখ্যা মিলিয়ে এ পর্যন- বন্ধকৃত খামারের সংখ্যা দাড়িয়েছে প্রায় ৩৫ ভাগ। আবার পেশা পরিবর্তন করে এ পেশায় ঝুঁকেছে প্রায় ২০ শতাংশ। তবে এ খাতে বিনিয়োকারীরা বলছেন সরকারের অনুকূল পরিবেশ পেলে এবং কৃত্রিম সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে ২০১৭ সালে এ খাতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সুন্দবন উপকূলে গরান, গোলপাতা, মাছ আহরনে বাধাগ্রস- হয়ে এসব বনজীবীরা পেশা পরিবর্তন করে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে অথবা সমবায়ের মাধ্যমে তাদের মূলধন এখন পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা গৃহস’লি পর্যায়ে পেশাটিকে বিকল্প আয়ের উৎস হিসাবে ধরে নিয়েছে।
মুরগির বাচ্চাসহ অন্যান্য উপকরনের মুল্য অস্বভামিক বৃদ্ধি, মুরগীর ব্চ্চার তীব্র সংকট, খামারীদের সহজ শর্তে ঋণ না দেয়া, বার্ডফ্লু পরবর্তী খামারীদের পুনর্বাসনের আওতায় না আনা, এনজিওদের ঋণের চাপ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ সংকট মহাসংকটে রুপ নিয়েছে। বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম অস্বাভাবিক হলেও খামার মালিকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে অনেকাংশে পুঁজি তুলতে পারছেন না। ফলে আরও পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন ও খামার মালিকরা জানিয়েছেন, খুলনাঞ্চলের পোল্ট্রি শিল্পের অমিত সম্ভবনা রয়েছে। বার্ডফ্লু সনাক্তকরণ ল্যাব স’াপন, কৃষিজ ভিলেজ স’াপনসহ বিভিন্ন দিক থেকে অন্যান্য জেলার তুলনায় খুলনা অনেক এগিয়ে রয়েছে। সরকারি প্রষ্ঠপোসকতা বৃদ্ধি পেলে শুধু এ অঞ্চলের উৎপাদিত ডিম ও মুরগি দিয়ে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। যা দিয়ে দেশীয় আমিষের চাহিদ পূরণসহ বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে।
জেলা পশু সম্পদ অফিস সূত্র জানায়, খুলনা জেলায় রেজিষ্ট্রার্ড ৩ হাজার ৭শ’ ৫০টি সহ ছোট বড় প্রায় ৩০ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছ্ে। বিভাগের ১০ জেলায় রয়েছে রেজিষ্ট্রার্ড ১৯ হাজার ২৬টি খামার। আর বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সূত্র অনুযায়ী খুলনায় রেজিস্ট্রার্ডসহ পোল্ট্রি খামার রয়েছে ৫ হাজার ৬শ’ ৬৫টি। বিভাগের ১০ জেলায় এ সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজারের কাছাকাছি। গত ৫ বছর পূর্বে সারাদেশেরে ন্যায় খুলনায়ও বার্ডফ্লু মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। সে সময় এর থেকে রক্ষা পেতে মহানগরীর ৪টি এলাকা থেকে ১৩ হাজার ৫শ’ ৪১টি মুরগি ও পাখি এবং ৪ হাজার ৭৩টি ডিম নষ্ট করা হয়। বার্ডফ্লু আতংকে বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার খামার। বেকার হয়ে পড়ে এর সাথে জড়িত ২৫/৩০ হাজার মানুষ। পরবর্তীতে সংকট কাটিয়ে উঠতে নানামুখি পদক্ষেপ নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে ১৪টি খামার এবং ১৩২ জন ব্যাক্তিকে ১০ লাখ ২ হাজার ৯শ’ ৪৯ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। কিন’ ৯০ ভাগ খামারি থেকে যান সরকারি সহযোগিতার বাইরে। ফলে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও সমস্যার বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেনি খামার মালিকরা।
সে সময়ে সরকারের কাছ থেকে উপযুক্ত সহযোগীতায় না পেয়ে পোল্ট্রি খামারীরা পড়ে বিপাকে। বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগের পর চরম সংকটের মুখে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন তারা। বার্ড ফ্লু পরবর্তী মূলধনের যোগড় করতে না পারা এবং পোল্ট্রি খাদ্যসহ অন্যার্ন্য উপকরনের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পোল্ট্রি চাষিদের সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে সংকট থেকে মুক্তি না পেয়ে অনেকেই কম দামে মুরগি ও ডিম বিক্রি করে খামার গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। আবার অনেকে খামার চালু রাখার স্বার্থে মোটা সুদে এনজিও থেকে ঋণ নেয়। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ঋণকৃত মূলধন নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। একদিকে ঋণের সুদ অন্যদিকে অব্যাহত লোকসান তাদের সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে সরকারি পদক্ষেপের কারণে বার্ডফ্লু আতংক অনেকাংশে দূর হয়ে গেলেও সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া এবং পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বড় চাষিরা খামার শুরু করতে পারেননি। এসময় মাহনগরীসহ জেলার বিভিন্ন স’ানে ছাত্র, চাকরিজীবীসহ পরিবারের মহিলার নিজ বাড়িতে স্বল্প পরিসরে পোল্ট্রি খামার গড়ে তোলেন। বর্তমানে চলতি সপ্তাহে বাজারে ব্রয়লার হাবার্ড বাচ্চা বিক্রি হয়েছে ৫২-৬০ এবং ফেডার বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা দরে। খাবার বিক্রি হয়েছে ২৩০০ থেকে ২৪০০ টাকা বস-া। হাঠাৎ করে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে এসব ক্ষুদ্র চাষিরা তাদের পোল্ট্রি খামার বন্ধ করে দেন। এভাবেই গত দুই মাসে বন্ধ হয়ে যায় আরও দেড় হাজার ক্ষুদ্র খামার। সাধারণত গরমের শুরুতে বাজারে ডিমের দাম কম থাকে। কিন’ শীতের শুরুতে বাজারে ডিমের দাম বাড়ছেই। উৎপাদন না থাকায় বাজারে মুরগি ও ডিম সরবারাহ হচ্ছে না। এ এব্যাপারে বাংলাদেশ পোল্ট্রি মুরগি ও ডিমের দাম সর্বকালের রেকর্ড দাড়িয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে খোলা বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি হালি ৩৬ থেকে ৪০ টাকা যা গত বছরের তুলনায় ৮ থেকে ১০ টাকা বেশী।
এব্যাপারে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডান্ট্রিজ এসোসিয়েশনের বিভাগীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতা এস এম সোহারাব হোসেন জানান, খুলনাঞ্চালে পোল্ট্রি শিল্পের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এর বিকাশের জন্য প্রয়াজন শুধু সরকারি পৃষ্টপোষকতা। তিনি জানান এ শিল্পকে ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করতে হবে। বিগত দিনের ক্ষতিগ্রস- চাষিদের পূনর্বাসনের আওতায় আনতে হবে। তিনি সরকারকে চাহিদা ও উৎপাদনের তালিকা তৈনি এবং সরকারের পক্ষ থেকে জনসাধারনের মাঝে সচেতনতা তৈরির জন্য জাতীয়ভাবে পোল্ট্রি সপ্তাহ ঘোষণার দাবি জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন সকল সংকট কাটিয়ে উঠে এ শিল্পটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তা জানান, খুলনার পোল্ট্রি শিল্প বিকাশে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
বি.এম.রাকিব হাসান
খুলনা.