ঘুরে দাড়াচ্ছে খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি শিল্প

 

চিংড়ি সেক্টরে বিল্পব ঘটানো সম্ভাব

বি.এম.রাকিব হাসান, খুলনা:  গত ৭ বছর কয়েক দফায় ইইউ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের পর বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের চিংড়ি সেক্টরটি শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আবার ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিপুল সম্ভাবনা এ খাতে। রীতিমত অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সহজভাবে এ খাত থেকে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব অন্য কোন খাত থেকে তা চিন-াও করা যায় না। উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার যে যার অবস’ানে থেকেই চিংড়ি চাষ করতে পারে। এর সাথে বেশ কয়েকটি ধাপে আরও কয়েক শ্রেণীর মানুষ জীবীকা নির্বাহ করছে। চিংড়ি চাষের পাশাপাশি ফিস ফিড, অবতরণ কেন্দ্র, প্রসেসিং সেন্টার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা এবং সর্বপরি রফতানি ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। খুলনাঞ্চলের মানুষের অহংকার বাংলাদেশের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্পের দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন এ অঞ্চলের উৎপাদক ও রপ্তানীকারক। সিডর এর করাল থাবা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আইলার আঘাতে তছনছ হয় চিংড়ি সেক্টর। চিংড়ি ঘেরগুলো আন-র্জাতিক বাজারে চিংড়ি রপ্তানির নিষেধাজ্ঞ, বারবার নাইপ্রোফুরান ভাইরাসের আক্রমণসহ বিভিন্ন সংকটে পড়া বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে এবং এ খাতে সঠিক নীতিমালা না থাকায় বিগত কয়েকটি অর্থ বছরে চিংড়ি খাতে রপ্তানী আয় কমে যায়। বিশেষ করে গত ৭ বছর এবং আইলায় অপূরনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।যে কারণে এ খাতের সংশ্ল্লিষ্টরা এই লোকসান কাটিয়ে উঠে এবার মৌসুমে একটি সাফল্যজনক পর্যায়ে আসতে চায়। রপ্তানীকারক ও উৎপাদনকারীরা এবার আশায় বুক বেধেছে। ঘুরে দাড়ানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা হবে এ সেক্টরে। এ অবস’ায় অত্যন- সম্ভবনাময় শিল্পটি অদূর ভবিষ্যতে আর বেশী পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। গত কয়েক বছরে নানান সংকটে পড়া এ শিল্পের সাথে জড়িত ৫ লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে কোমর বেধে মাঠে নেমেছে। তারা অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে জীবনের পরিবর্তন আনতে চায়। চলতি মৌসুমের শুরুতেই প্রানি-ক চিংড়ি চাষিরা তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে ঝাপিয়ে পড়েছে।
চিংড়ি উৎপাদক ও রপ্তানীকারকরা জানান, ২০০৭ এর ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ আকষ্মীক ভাবে সম্ভাবনাময় এ অঞ্চলের চিংড়ি শিল্পের ওপর মারাত্বক আঘাত হানে। আসলেই এ শিল্পটি অনেকখানি প্রাকৃতিক সুবিধা নির্ভর। প্রকৃতির পরে কারো হাত নেই। যে কারণে সিডরে বৃহত্তর খুলনার তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার চিংড়ি ঘের পানিতে ভেসে যায়। এছাড়া আরো অর্ধলক্ষ ছোট-বড় ঘের আংশিক ক্ষতিগ্রস- হয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে সন-ানের মতো চিংড়ি মাছগুলো লালন করছিল মূহুর্তেই তা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কয়েক হাজার কোটি টাকার চিংড়ি হারিয়ে পথে বসে তারা। কিন’ তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েনি। সরকারী-বেসরকারী ঋণ সহায়তা নিয়ে সিডরের পর আবার ঘুরে দাঁড়ায় চিংড়ি শিল্পের সাথে জড়িতরা। সকল চড়াই উৎরাই পার হয়ে চিংড়ি চাষীরা বীরের মতো নিজেদের অবস’ান স্বল্প সময়ে মজবুদ করে নেয়।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানায়, ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছরে বৃহত্তর খুলনাসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলা থেকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানী করে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ৬৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে এ আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৬৭ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। উৎপাদকরা সিডরের ক্ষতি অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠতে সম্ভব হয়েছিলেন বলেই ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে রপ্তানীর পরিমাণ বেড়েছিল। এটি ছিল এ শিল্পের জন্য একটি সবুজ সংকেত। নতুন নতুন চাষী এবং এ শিল্পে সংশ্লিষ্টরা ভিড় জমায় নতুন উদ্যোমে। ফলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেছিল একটি মজবুদ অবস’ানে চিংড়ি শিল্প ফিরে যাবে। কিন’ সিডরের ক্ষতি কোনো রকমে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখা দেয় চিংড়িতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নাইট্রোফুরান ভাইরাসের আর্বিভাব। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের চিংড়িতে নাইট্রোফুরান রপ্তানীকৃত বিপুল পরিমাণ চিংড়ি ফেরত পাঠায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন- ভাইরাস ইস্যুতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি ইউরোপসহ অন্যান্য আন-র্জাতিক বাজার থেকে ফেরত পাঠানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনীহার কারণে সরকার ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে বিদেশে চিংড়ি রফতানীর ওপর ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকারের এ সিদ্ধানে-র নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমগ্র চিংড়ি রপ্তানী শিল্পের ওপর। চিংড়ি চাষিরা চিংড়ি চাষের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অপরদিকে এ অঞ্চল লবণাক্ত হওয়ার কারণে কোনো ফসল উৎপাদনও করাও তাদের পক্ষে দুরহ হয়ে ওঠে। পরিসি’তি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়ায় যে চিংড়ি শিল্প একেবারেই বন্ধ যাওয়ার উপক্রম হয়। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত অভ্যন-রীণ বাজারেও চিংড়ির দাম কমে যায়।
চিংড়ি শিল্পে যখন চরম সংকট সৃষ্টি হয় ঠিক সে সময়ে এ অঞ্চলে আঘাত হানে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস “আইলা”। সিডরের কারণে শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া চিংড়ি শিল্পের উপর আবারও আঘাত হানে আইলা। আইলায় বৃহত্তর খুলনার লক্ষাধিক চিংড়ি ঘের পানিতে তলিয়ে যায়। ভেসে যায় কয়েক জাহার কোটি টাকার চিংড়ি। সর্বস্বান- হয়ে পথে বসেন চিংড়ি ব্যাবসায়ী ও চাষীরা।
রফতানী উন্নয়ন ব্যুরো জানায়, ২০০৫-২০০৬ ও ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে চিংড়ি খাতে আয় হয় ৩ হাজার ২ শত কোটি টাকা। অথচ রফতানী আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ২ শত কোটি টাকা। গত ২০১৩ -১৪ অর্থ বছরে চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হয় নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানী শুরু হয়েছে। রপ্তানীর ধারা বজায় রাখতে উৎপাদক, রপ্তানীকারক ও এর সাথে জড়িতরা সর্বত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে চলতি অর্থ বছরে রপ্তানী আয় ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত চিংড়ির শতকরা ৭০ ভাগ এ অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে খুলনাঞ্চলের ৫২টি চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে প্রায় ৩৫ টি চালু আছে। আন-র্জাতিক বাজারে চিংড়ির দরপতন, চিংড়ি খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি,যথা সময়ে ঋণ না পাওয়া ও উৎপাদন হ্রাসসহ নানা কারণে চালু কয়েকটি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চিংড়ি শিল্পের সাথে এ অঞ্চলে কমপক্ষে ৫-৬ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। পরোক্ষভাবে জড়িতের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। তবে সংকটকালে চিংড়ি শিল্পের সংকটে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ৫ লাখ মানুষ বেকার হতে চলেছিলেন। কিন’ চিংড়ি শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেস্টা করায় তাদের তাদের সে হতাশা কেটে গেছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post