বৃহত্তর খুলনায় অর্ধশতাধিক সমিতি অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে

বি. এম. রাকিব হাসান, খুলনা:  দারিদ্রবিমোচনের নামে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বৃহত্তর খুলনায় প্রায় অর্ধশতাধিক সমিতি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ সুদ গ্রহন করে সাধারন মানুষকে সর্বস্বান- করছে। এতে প্রানি-ক পারিবারগুলো আরও নি:স্ব হচ্ছে। এই খাত থেকে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব । এ সকল সমিতি বা এনজিও এখন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পুঁজি নিয়ে মাঠে কাজ করছে। এ সকল সংস’ার ৯০ শতাংশেরই সমাজ সেবা অধিদফতরের অনুমোদন নেই। ইতোমধ্যে মেট্রো বর্ণিক সমিতি নামে একটি সমিতির লোকজনের কাছ থেকে চড়া সুদ দেয়ার কথা বলে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস’া সমিতিগুলোর ওপর নজরদারিসহ তাদের কার্যক্রমের উপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, শিয়ালিডাঙ্গা সমবায় সমিতি, হালিয়া সমিতি, রয়েল সঞ্চয় প্রকল্প, মেট্রে বনিক সমিতি, ন্যাশনাল সমিতি, আদর্শ সমিতি, পরিচিতি উন্নয়ন তহবিল, কিংশুক সমবায় সঞ্চয় প্রকল্প, চয়েজ ব্যবসায়ী উন্নয়ন তহবিল, পদ্মা জন কল্যান সমিতি ছাড়াও খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অর্ধ শতাধিক সমিতি রয়েছে।
সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরনের কথা বলে এ সব সমিতি সাধারন গ্রাহকদের চড়া সুদ দেয়ার কথা বলে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। আবার সমিতিগুলো ঋন দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী গৃহবধূসহ তৃনমুল পর্যায়ে সঞ্চয় সংগ্রহ এবং এক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋন থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক ঋন প্রথা চালু করে। সহজ শর্তে ঋন পাবার আশায় সাধারন মানুষ এ সকল সংস’ার প্রতি ঝুকে পড়ে। দৈনিক, সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কিসি-তে ঋন আদায় শুরু হলে গড় হিসাবে দেখা যায় সুদের হার ৩০%্ব থেকে ৪০%। প্রথমদিকে নগরীর বড় বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের ঘিরে এসব সমিতির কার্যক্রম চালু হয় । নগরীর বড় বাজার, কালিবাড়ী, হকার্স মার্কেট, চালপট্রি, নিউমার্কেট, হার্ডমেটাল গ্যালারি, খালিশপুর ও দৌলতপুর বাজারে এসব সমিতির কার্যক্রম চালু হওয়ার পর পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্ধশতাধিক সমিতি প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসে দশ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন- বিভিন্ন অংকের আমানত সংগ্রহ করে চলেছে। মেয়াদ শেষে আমানতকারীকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলা হয়।
এসব সমিতি থেকে ঋন নেয়া একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স’ানীয় প্রভাবশালী ৫/৬ জন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী মিলে একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতির কর্মকর্তারা নিজেরা কিছু অর্থ বিনোয়গ করেন এবং সদস্যের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করেন তা সদস্যদের মাঝে ঋন হিসাবে বিতারন করেন। আর ঋনের বিপরীতে নেয়া হয় চড়া সুদ। এসব সমিতি জামানত ছাড়াই পাঁচ হাজার থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন- ঋন দেয়। বিনিময়ে প্রতি লাখে প্রতি মাসে দেড় থেকে চার হাজার টাকা লভ্যাংশ বা সুদ নেয়। তবে সমিতি সংশ্লিষ্টদের দাবি ঋনের বিপরীতে তারা মাসে সর্ব্বোচ দশ থেকে ১২ শতাংশ লভ্যাংশ নেন।
২০০০ সালের নগরীর বড় বাজার এলাকায় গড়ে ওঠে মেট্রো বনিক সমিতি। অল্প সময়ের মেট্রো বনিক সমিতি প্রসার লাভ করে। সমিতির প্রধান দীন নেওয়াজ খান আলম প্রায় দেড় হাজার আমানতকারীর ৫২ লাখ টাকা আত্মসাত করে ২০০৫ সালে আত্মগোপন করেন। এই সমিতির সদস্যরা এখন তাদের আমানত ফেরত পাওয়ার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। অনেকে খুলনা মেট্রোপলিটন ষ্টেশনারী ব্যবসায়ী সমিতির কাছে বিচারও চেয়েছেন। খোজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর পূর্ব বানিয়াখামার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে জনকল্যান সমিতির কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে তাদের সদস্য প্রায় চার হাজার এবং সংগৃহীত আমানতের পরিমান প্রায় ১০ কোটি টাকা। এই সমিতি খুলনা সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং কিংশুক সমবায় সঞ্চয় প্রকল্প ঢাকার সমাবয় অধিদপ্তরের নিবন্ধন রয়েছে। এসব নিবন্ধনকেই তারা তাদের ব্যাংকিং কাযক্রমের বৈধতার ছাড়পত্র বলে দাবি করেন। এ ব্যাপরে খুলনা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বলেন, সমাজ সেবা থেকে রেজিষ্ট্রশন নিয়ে ঋন কার্যক্রম চালানো যাবে না। কেউ ঋন কার্যক্রম বা ব্যাংকিং সিষ্টেম চালালে তা হবে সম্পূর্ন অবৈধ। জনকল্যান সমিতির পরিচালনা পর্ষদের এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৯ সালে তারা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়েছেন। বর্তমানে এর সদস্য ও শেয়ার সংখ্যা দুই কোটি টাকা। সমিতির আড়ালে ব্যাংকিং ব্যবসা বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকটা ব্যাংকের মতোই। তার দাবি তারা মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছে।
নগরীর বড় বাজার প্রগতি সমিতির সদস্য সংখ্যা দুই হাজারের বেশী। সমিতির আমানতের পরিমান তিন কোটি টাকা। সমিতি পরিচালনায় এসএম ওবায়দুল্লাহ অনুমোদন না থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুজির সংস’ান করতেই এ সমিতির কাজ শুরু করা হয়েছিল। দেশে জরুরী অবস’া জারির পর সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। বড় বাজার এলাকায় সরজমিন ঘুরে এসএম ওবায়দুল্লার কথার সত্যতা পাওয়া যায়নি। এভাবে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার শিয়ালিডাঙ্গা সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা ঋন প্রদান ও ঋন আমানত সংগ্রহ দীর্ঘ ১২ বছর যাবৎ করে আসছি। তিনি সমিতির পুজি সঠিক হিসাব জানাতে অপরাগত প্রকাশ করলেও স্বীকার করে বর্তমান সমিতির মোটা অংকের পুজি রয়েছে। এ ভাবে বৃহত্তর খুলনার জেলা সদর ও উপজেলার প্রত্যন- অঞ্চলের নিয়মবহিভূর্তভাবে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেনীর দালাল শ্রেনী অবৈধভাবে ব্যাংকিং পদ্ধতি চালিয়ে সরকারী রাজস্ব প্রদান না করে রাতারাতি বিপুল পুজির মালিক হচ্ছেন। সরকারের কড়াকড়ি সত্ত্বেও এ সকল সংস’াগুলো কিভাবে অবৈধ পন’ায় ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা জনগনের বোধগম্য নয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post